প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ সাংবাদিক কাজলকে নিয়ে ছেলে আবেগঘন চিঠি

সাংবাদিক কাজলকে নিয়ে ছেলে আবেগঘন চিঠি

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

যশোরের বেনাপোলে উদ্ধার হওয়া ফটোসাংবাদিক ও ‘দৈনিক পক্ষকাল’ এর সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল নিখোঁজের ৫৪ দিনের কোনো কিছুই মনে করতে পারছেন না। দীর্ঘ বন্দীজীবনে অপহরণকারীরা তাকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করেছে। সারাক্ষণ হাত, পা, চোখ, মুখ বেঁধে রেখেছে। শুধু খাওয়ার সময় মুখ ও চোখ খুলে দেওয়া হতো। পুলিশের কাছে কাজল এমনই তথ্য দিয়েছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছেন।

এদিকে, সাংবাদিক কাজল নিয়ে তার ছেলে মনোরম পলক একটি আবেগঘন চিঠি লিখেছেন। তার চিঠিটি হুবহু তুলে ধরা হলো:

৫৩ দিন পরে ৫৪ ধারার মা’মলা। পিঠমোড়া করেতো শুধু কাজলকে বাধেনি, আমাদের পুরো পরিবারটিকে বেঁধেছে একসাথে। একটার পর একটা মামলা দিয়ে বাঁধছে। আমাদের পরিবারে আমরা ৫ জন মানুষ। মা’থাপ্রতি একটি করে মা’মলা।

তিনটি “Digital security act” মামলা দিয়েছে ধরেন একটি আমার বাবার মাথা গুনে, একটি আমার মা জুলিয়া ফেরদৌসকে , একটি আমি মনোরম পলকের মাথা ভেবে। এই গেলো তিনটি মা’মলার হিসাব। তারপর ধরেন আমার ১১ বছরের বেয়াড়া ছোট বোনের মাথা কা’উন্ট করে দেশ উপহার দিলো ৫৪ ধারার মামলা। এরপর আমাদের সাথে থাকেন আমার নানাভাই। নানাভাইকে মা’থায় রেখে বি’জিবি দিলো অবৈধ অনুপ্রবেশের মা’মলা। এই একটি মাত্র ‘মামলায় আমার বাবা এবং আপনাদের কা’জলের জামিন হয়েছে। নানাভাই আপাতত দুধ ভাত।

প্রথম ৫৩টা দিন আমরা ছিলাম শোকে কাতর তবুও আমরা ছিলাম প্রচন্ড রকমের আশাবাদী। আপনাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন “কাইট্যা ভাসিয়ে দিয়েছে কখন”, অনেকেই বলছেন “ফিরে আর পাবেন না”, আবার অনেকেই বলছেন সঙ্গে আছি, সঙ্গে থাকবো। আমরা দুই বিপরীতমুখী টানে আমরা ৫টা প্রাণী মাঝখানে সিধা দাঁড়িয়ে ছিলাম। রাষ্ট্র বলেন বা দেশ বলেন অথবা সিস্টেম, আমাদেরকে নিজ ঘরের সবচেয়ে অন্ধকার অংশে কোনঠাসা করে রেখেছিলো। আমরা সেখানে ৫টা প্রাণী প্রতিদিন পালা করে কেঁদেছি।

মনে হয়েছিলো আমরা ৫ জন একটা চিকন সরু তারের উপর দুদোল্যমান। কতবার যে সেই তার থেকে নিচে পরেছি। রক্তাত্ব মুখটা নিয়ে আবার উঠে দাঁড়িয়েছি সেই তারে আপনাদের অনেকের বাড়ানো হাতটি ধরে। টিভি মিডিয়ার ব্যক্তিত্ব, শিল্প নির্দেশক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিক, মানবা’ধিকার কর্মী এরকম বহুজনের কথা এখন মনে পরছে যাদের বাড়ানো হাতে আমরা শক্তি পেয়েছি।

এখন আমাদের “মে ইন যশোর ডেইজ” শুরু। আমাদের আর আমাদের চার দেয়ালের ঠুনকো নিরাপত্তা’র মধ্যে পুরে রাখেনি আপনাদের রাষ্ট্র। আমাদেরকে টেনে হিঁচড়ে যশোরে নিয়ে গেছেন। আমাদের গায়ের চামড়া সরু তার থেকে পরতে পরতে, তদুর্যপরি অদৃশ্য চাবুকের একটার পর একটা আ’ঘাতে কবেই ছিলে নিয়েছে।

আমাদের পুরো পরিবারটিকে পিঠে হাত মোড়া দিয়ে বেঁধেছে। আমাদের মুখ বাধা লাল গামছায়। আমাদের পায়ে টাকা নামক অভাবের শিকল দিয়ে বাধবে বাধবে বলে তাদের নীল নকশা তৈরি।

আমরা কোর্ট করবো , কাচারী করবো। আমাদের খালি গতর থেকে মাংসের দলা আদালতের সিঁড়িতে এবং জেল ফটকের সামনে স্লো মোশনে খসে খসে পরবে। তাও আমরা এক দণ্ডের জন্য থামবো না।সিঁড়ির পর সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে আমাদের পায়ের গোড়ালিতে কেলাস পরবে, পড়ুক। আমাদের বাজার করতে একবার ভাবতে হবে, ভাববো। আমাদের প্রতিদিনকার মতো যতটুকু ঘুমুতে পারি, ঘুমুতে যাওয়ার আগে কল্পনা করে নিতে পারি বাবা আমাদের থেকে ঠিক জানা দুরুত্বে জেলখানায় পাশ ফিরে আমাদের মতোই ঘুমুতে যাওয়ার চেষ্টা করছেন।

আমাদের কথা জড়িয়ে যাবে, যাক। আমি মনোরম পলকের মনোবলের প্রাচীরে চিড় ধরাতে নানারকম চেষ্টা করবে, করুক। সেই ফাটলে আমি আমা’দের ছাপা প্রিন্টের চাদর দিয়ে টান টান করে বাঁধবো। চাদরটা যখন সরাতে যাবো তখন চাদরে থাকবে আমাদের অনুভূতির নানা রকম রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। আমাদেরকে চামড়া বিহীন অনেক কুৎসিত লাগবে। আমরা আমাদের সেই কুৎসিত পরিবেশনা নিয়ে সিস্টেমের মুখোমুখি দাঁড়াবো। আশা করছি আপনারা ছাপা প্রিন্টার ফুলগুলিকে দেখবেন। রক্তের দাগ আপনাদের জন্য নয় বলে রাখছি।

কিন্তু দিন শেষে আমরাও তো মানুষ। আমাদের প্রচুর যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে যখন আমাদের চামড়া তোলা হচ্ছিলো। আর এখন একটা মধ্যবিত্ত শরীরে যতুটুকু মাংস থাকে তার থেকে খাবলার পর খাবলা তুলে নিচ্ছে প্রতিনিয়ত। দলার পর দলা এখানে সেখানে আমাদের মাংস পি’ন্ড আপনারা এখন পরে থাকতে দেখবেন। আপনাদের থেকে লুকাবো না। সত্যি বলতে কি, আমাদেরও আপনাদের মতোই কষ্ট হয় একটু কম আর বেশি। মনে হয় কেউ আমাদের হৃদপিন্ডে ক্রমাগত সাঁড়াশি চালাচ্ছে।কিন্তু এও জানবেন সেই ধারালো সাঁড়া’শি আপনাদের ভালোবাসার কাছে নস্যি।

বাবাকে যখন দে’খি পিঠে পিছমোড়া করে বাধা হ্যান্ডকাফে, কলিজাটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। অপমানে লজ্জায় চোখের পানি আগুন হয়ে বাস্প হয়ে উড়ে গেছে আপনা’তেই। দিনশেষে যখন আপ’নাদের কাছে আসি তখন দে’খতে পাই বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পী সব্যসা’চী হা’জরা আমার বাবার পিঠে আড়’মোড়া করে বা’ধা ছবির অনুরূ’পে একটি পো’স্টার করে কা’জলের মুক্তি চে’য়েছেন; দিনের আলো’র অপমান এবং লজ্জা রাতের মিশ’কালো অন্ধ’কারে সেই পো’স্টার’খানা জ্বল’জ্ব’ল করে আমাকে আমার যাবতীয় অপ’মা’নের হাত থেকে বাঁচি’য়েছে।

তারপর ধরেন সাংবা’দিক গো’লাম মোর্তোজার তাৎক্ষণিক প্রতি’ক্রিয়ার “পিঠ’মোড়া করে হাতকড়ায় বাঁধা ক্যামে’রাশিল্পী’” হেড’লাইন আমার বাবা’কে ফটো’সাংবা’দিক থেকে এক মুহূর্তেই ক্যা’মেরাশি’ল্পী করে তার প’রিধির সী’মা বা’ড়িয়েছেন। আমার বাবাকে নিয়ে আমার গর্ব প্রতি’দিনই বাড়ছে আপ’নাদের দেওয়া মলমে এবং এ’ন্টিবায়ো’টিকে। আপনাদের কাছ থেকেই প্রতি’নিয়ত মূলো’বোধ আর সম্মা’নের সংজ্ঞা শিখছি। আমাদের চামড়া বিহীন গত’রের সর্বদা বিদ্যমান জ্বা’লাকে মুহুমুহু প্রশা’ন্তি দিচ্ছে আপনাদের দেওয়া মলম এবং এ’ন্টিবায়ো’টিক।

সবাই হয়তো ম’লম এবং এন্টি”বায়ো’টিক দিতে পারবে না , কিন্তু আম’রা বাঙালি আমরা সবাই টো’টকা দিতে পারি যে’কো’নো সময়। আপনা’দের মধ্যে যারা শিল্পী , লেখক , সমাজ কর্মী , ডিজাই’নার এবং যত ক্রিয়ে’টিভ মাধ্য’মের আছেন তাদে’রকে বলছি আপনারা আমাদেরকে মলম এবং এন্টি’বা’য়োটিক সরবরাহ দিতে থাকেন। আমাদের লজ্জা থেকে বাঁ’চান। আমাদের আ’গুনপু’ড়া শরী’রে আপনাদের ম’লম খুবই দরকার। আমাদেরকে [email protected] ঠিকানায় , পেইজ এর ইনবক্স এ বিভিন্ন পোস্টার , লেখা , গান , কবিতা , ভিডিও বার্তা পাঠাতে থাকুন, এই সময় আপনাদের থেকে এর বেশি আশা করছিনা।

জেনে রাখবেন আপনাদের মনোরম পলক আপ’নাদের প্রচন্ড শ্র’দ্ধা করে এবং ভালোবাসে।আপনাদের মল’ম, এ’ন্টিবায়ো’টিক এবং টো’টকার অপেক্ষা’য় রইলাম।

ইতি

আপনাদের

মনোরম পলক