প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ করোনা ধাঁধা: ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কোথাও কম, কোথাও বেশি কেন?

করোনা ধাঁধা: ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কোথাও কম, কোথাও বেশি কেন?

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

করোনা ভাইরাসে (কভিড-১৯) ইরানে এত মানুষ মারা গেছে যে, তাদের দাফনে গণকবর খুঁড়তে হয়েছে। অথচ, পাশের দেশ ইরাকে ভাইরাসটিতে প্রাণ হারিয়েছেন ১০০ জনেরও কম। একইভাবে ডমিনিকান রিপাবলিকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮ হাজারের বেশি মানুষ। কিন্তু পাশের দেশ হাইতিতে আক্রান্তের সংখ্যা মাত্র ১০০। ধারণা করা হয়, ইন্দোনেশিয়ায় ভাইরাসটিতে প্রাণ হারিয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। তাদের প্রতিবেশী দেশ মালয়শিয়ায় এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা মাত্র ১০৫।

করোনা ভাইরাস বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই হানা দিয়েছে। কিন্তু দেশ ভিত্তিতে এর প্রাদুর্ভাবে অনেক হেরফের দেখা গেছে। নিউ ইয়র্ক, প্যারিস ও লন্ডনের মতো বৈশ্বিক মেট্রোপলিসগুলোকে বিপর্যস্ত করে দিয়েছে এই ভাইরাস।

একই সময় ব্যাংকক, বাগদাদ, নয়া দিল্লির মতো জনবহুল শহরগুলোয় এখন পর্যন্ত এর সংক্রমণ সীমিত।

ভাইরাসটির প্রাদুর্ভাব কিছু জায়গায় এত বেশি ও কিছু জায়গায় এত কম কেন? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর এখনো জানা নেই গবেষকদের। তবে এর ব্যাখ্যায় রয়েছে নানা তত্ত্ব ও জল্পনা। ভাইরাসটির জন্য সহায়ক ও প্রতিকূল পরিবেশ চিহ্নিত করা গেলে, সেটি প্রতিরোধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া সহজ হয়ে পড়বে বিশ্বের জন্য। বিশ্বজুড়ে ভাইরাসটির প্রভাব নিশ্চিতে জনমিতি, বিদ্যমান পরিবেশ, জেনেটিকসসহ শত শত বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা।

সৌদি আরবে চিকিৎসকরা জিনগত পার্থক্যের সঙ্গে ভাইরাসটির প্রভাবের সম্পর্ক খুঁজে বের করতে গবেষণা করছেন। ব্রাজিলে গবেষকরা জিন ও ভাইরাসটির জটিলতার মধ্যে সম্পর্ক খুঁজছেন। বেশ কয়েকটি দেশে গবেষকরা ‘হাইপারটেনশন’ চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধ ব্যবহারে ভাইরাসটির জটিলতা বৃদ্ধি পায় কিনা তা নিশ্চিতে গবেষণা করছেন। আবার কিছু দেশে যক্ষ্মা নিরাময়ে ব্যবহৃত ওষুধ ভাইরাসটির চিকিৎসায় ব্যবহার করা নিয়ে পরীক্ষা চালানো হচ্ছে।

উষ্ণ আবহাওয়া ও তরুণ জনসংখ্যাপূর্ণ অনেক উন্নয়নশীল দেশে করোনার বিস্তার ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি, অল্পের উপর দিয়ে চলে গেছে। এ থেকে এমন ধারণা পাওয়া যায় যে, হয়তো তাপমাত্রা ও জনমিতির সঙ্গে এর বিস্তারের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু পেরু, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিলের মতো গ্রীষ্মকালীন দেশগুলোতে মহামারি এত জটিল আকার ধারণ করেছে যে, ওই ধারণা অচিরেই ভিত্তিহীন হয়ে পড়েছে।

ড্রাকোনিয়ান সামাজিক দূরত্ব ও শুরুর দিকেই লকডাউন জারিতে কিছু দেশ নিশ্চিতভাবে সফলতা পেয়েছে। কিন্তু মিয়ানমার ও কম্বোডিয়া কোনো বিধিনিষেধ আরোপ না করেও ভাইরাসের ছোবল থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে। একটি অপ্রমাণিত তত্ত্ব হচ্ছে, হয়তো ভাইরাসটি এখনো ওই দেশগুলোকে পুরোপুরি জেঁকে ধরেনি। উদাহরণস্বরূপ রাশিয়া ও তুরস্কের কথা বলা যায়। দেশ দুটিতে অনেকদিন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আচমকাই আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে বেড়ে গেছে।

এখন অবধি সবচেয়ে কার্যকর সমাধান হতে পারে ‘সময়’। তবে সেটা নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে স্প্যানিশ ফ্লু সংক্রমণ ঘটে ১৯১৮ সালে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছিল, গ্রীষ্মের উষ্ণতায় ফ্লুকে তাড়িয়ে দেবে। কিন্তু দেখা গেছে, বর্ষায় তা আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছিল। একই বছরে তিন দফায় আক্রমণ চালিয়েছিল দেশটিতে।

করোনার ক্ষেত্রে ঠিক কী কারণে ভাইরাসটি আগ্রাসী আচরণ করে তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। হার্ভার্ড গ্লোবাল হেলথ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের পরিচালক ডা. আশিষ ঝা বলেন, আমরা এই রোগটির খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছি। এটা যদি কোনো বেসবল খেলা হতো, তাহলে আমরা এখন দ্বিতীয় ইনিংসে আছি। এমনটা ভাবার কারণ নেই যে, এখন পর্যন্ত বিশ্বের যেসব জায়গায় এর প্রাদুর্ভাব কম দেখা গেছে, নবম ইনিংসের মধ্যে সেগুলোয় অন্যান্য স্থানের মতো সংক্রমণ হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাসটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার জন্য পর্যাপ্ত তথ্য নেই তাদের কাছে। অনেক দেশেই ভাইরাসটি শনাক্তে পরীক্ষার হার অত্যন্ত কম, যে কারণে সেখানে এর সংক্রমণ সম্পর্কে প্রকৃত তথ্য জানা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক দেশে হিসাব রাখা হচ্ছে না, প্রকৃত মৃতের সংখ্যারও। তবে এসব সত্ত্বেও বিস্তৃত পরিসরে কিছু প্যাটার্ন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যেসব জায়গায় রেকর্ড রাখায় গুরুত্ব দেয়া হয় না ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভঙ্গুর সেসব জায়গায়ও গণকবর দেয়া বা হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা না দিয়ে হাজারো মানুষকে ফিরিয়ে দেয়ার খবর চাপা থাকবে না। অন্যদিকে, কিছু জায়গায় এখনো ভাইরাসটি সংক্রমণের চূড়ায় পৌঁছায়নি। করোনার দ্বিমুখী আচরণের কারণ চিহ্নিত করতে বিশ্বজুড়ে দুই ডজনের বেশি বিশেষজ্ঞদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমস। তারা এর সংক্রমণের হেরফেরের পেছনে চারটি নিয়ামক তুলে ধরেছেন। তাহলো- জনমিতি, সংস্কৃতি, পরিবেশ ও ভাইরাসটি মোকাবিলায় সরকারের নেয়া পদক্ষেপ।

উল্লেখিত চারটি কারণের প্রত্যেকটির পক্ষেই সমার্থক তথ্য রয়েছে। আবার সেগুলোর বিরোধিতাকারী প্রমাণও রয়েছে। যেমন, ধারণা করা হয়, বয়স্করা এই ভাইরাসে সবচেয়ে ঝুঁকিতে আছেন। কিন্তু তেমনটি হলে জাপানের অবস্থান মৃতের তালিকার শুরুর দিকে হওয়ার কথা ছিলো। সেখানে মৃতের সংখ্যা মাত্র ৫৩৬ জন। তবে সকল কিছু বিবেচনায়, আপাতত বিশেষজ্ঞরা উপর উল্লেখিত নিয়ামকগুলোকেই সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তারুণ্যের শক্তি :

ভাইরাসটির ভয়াল থাবা থেকে বেঁচে যাওয়া অনেক দেশেরই জনসংখ্যা অপেক্ষাকৃত তরুণ। জন হপকিন্স স্কুল অব মেডিসিনের সংক্রামক রোগ বিষয়ক অধ্যাপক রবার্ট বলিংগার বলেন, তরুণদের মধ্যে মৃদু বা উপসর্গহীন সংক্রমণের হার বেশি। তাদের কাছ থেকে অন্যদের আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা অনুসারে, কভিড-১৯ জটিল আকার ধারণ, বিশেষ করে প্রাণঘাতী করে তোলায় সহায়ক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যাও তরুণদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম থাকে।

আফ্রিকায় এখন পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৫০ হাজারেরও কম। ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মহাদেশ হিসেবে, এ সংক্রমণের হার অত্যন্ত কম। পুরো বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি তরুণ জনসংখ্যা সেখানে। পুরো মহাদেশের ৬০ শতাংশ জনগণের বয়সই ২৫ বছরের কম। অন্যদিকে থাইল্যান্ড ও ইরাকের নাজাফে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা চিহ্নিত করেছেন যে, ২০-২৯ বছর বয়সীরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন, কিন্তু তাদের মধ্যে লক্ষণ তুলনামূলকভাবে কম দেখা গেছে।

এদিকে, বিশ্বে করোনার প্রাদুর্ভাব সবচেয়ে বেশি দেখা যাওয়া দেশগুলোর একটি ইতালি। দেশটির জনসংখ্যার গড় বয়স ৪৫ বছরের বেশি। সেখানে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের গড় বয়স ৮০ বছরের কাছাকাছি। সিঙ্গাপুরের নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির জনসংখ্যা ও বৈশ্বিক স্বাস্থ্য বিষয়ক অধ্যাপক জোসিপ কার বলেন, তরুণদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা সাধারণত শক্তিশালী হয়ে থাকে।

উদাহরণস্বরূপ, সিঙ্গাপুর ও সৌদি আরবে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন বিদেশি শ্রমিকরা। এদের বেশিরভাগই বাস করেন ঘনবসতিপূর্ণ ডরমিটরিতে। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই তরুণ ও সুস্থ। আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হলেও তাদের বেশিরভাগেরই হাসপাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন পড়েনি।

মার্কিন গবেষকরা বলছেন, তারুণ্যের পাশাপাশি কোনো দেশের সার্বিক সুসাস্থ্যও ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে ভূমিকা রাখে। তবে জনমিতির এই ব্যাখ্যার বিপরীত চিত্রও দেখা গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জনসংখ্যার বসবাস জাপানে। তা সত্ত্বেও সেখানে প্রাণহানীর হার ৬০০’র কম। অন্যদিকে, ইকুয়েডরের সবচেয়ে বেশি করোনা আক্রান্ত অঞ্চল গুয়ায়াসে এখন পর্যন্ত ৭ হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অথচ সেখানকার বেশিরভাগ জনসংখ্যাই তরুণ। পুরো অঞ্চলে ৬০ বছরের বেশি বয়স্ক জনসংখ্যার হার মাত্র ১১ শতাংশ।

সাংস্কৃতিক দূরত্ব :

সামাজিক দূরত্বের মতো সাংস্কৃতিক নিয়ামকগুলো যেসব সমাজে বেশি প্রতিষ্ঠিত সেসব সমাজ করোনার থাবা থেকে কিছুটা সুরক্ষা পেয়ে থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন মহামারি বিশেষজ্ঞরা। থাইল্যান্ড ও ভারতে সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম। দেশ দুটিতে মানুষ কুশল বিনিময়ের ক্ষেত্রে দূরত্ব বজায় রেখে চলে। দূর থেকেই প্রার্থনার মতো হাতের তালু একসঙ্গে করে সম্মান জানায়। জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ায় দূর থেকে দাঁড়িয়ে নত হয়ে সম্মান জানানো হয়। এছাড়া এই দেশ দুটিতে আগ থেকেই মাস্ক পরার হার বেশি।

এদিকে, বেশিরভাগ উন্নয়নশীল দেশে বৃদ্ধদের সাধারণত নার্সিং হোমে পাঠানো হয় না, বাড়িতে কনিষ্ঠরাই তাদের দেখাশোনা করে থাকে। করোনায় বিপর্যস্ত পশ্চিমা দেশগুলোতে অবশ্য এর বিপরীত চিত্র দেখা যায়।

তবে সাংস্কৃতিক দূরত্ব তত্ত্বের বিরুদ্ধেও প্রমাণ পাওয়া গেছে। মধ্য প্রাচ্যীয় অনেক দেশে সাধারণত কুশল বিনিময়ের ক্ষেত্রে হাত মেলানোই প্রথা হিসেবে প্রচলিত। তা সত্ত্বেও ওইসব দেশে সংক্রমণের হার কম দেখা গেছে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে আরোপিত লকডাউন ও সামাজিক দূরত্ব বিষয়ক নিয়ম কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে বলা যায়।

গরম ও আলো : 

করোনা সবচেয়ে দ্রুত ছড়িয়েছে কম তাপমাত্রার দেশগুলোতে- যেমন, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালি। অন্যদিকে চাদ বা গাইয়ানার মতো উচ্চ তাপমাত্রার দেশগুলোতে এর সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে অতি নগণ্য। এ থেকে অনেকে ধারণা পোষণ করেছেন যে, ভাইরাসটি উচ্চ তাপমাত্রায় দুর্বল হয়ে পড়ে ও কম তাপমাত্রায় শক্তিশালী থাকে। যদিও গবেষকরা এই তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানাননি। উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ কিছু সংক্রমণ দেখা গেছে উচ্চ তাপমাত্রার দেশগুলোয়- যেমন, ব্রাজিল।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির সেন্টার ফর কমিউনিক্যাবল ডিজিস ডাইনামিকসের পরিচালক মার্ক লিপস্টিচ বলেন, সবচেয়ে ভালো ধারণা হচ্ছে, গ্রীষ্মের আবহাওয়া ভাইরাসটি মোকাবিলায় সহায়ক হবে। তবে, কেবল উষ্ণ আবহাওয়াই ভাইরাসটির সংক্রমণ কমাতে পর্যাপ্ত নয়।

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির বায়োলজিস্ট ড. রাউল রাবাদান বলেন, ভাইরাসটি এত বেশি সংক্রামক যে এটি গরম ও আদ্রতার প্রভাব সহজেই কাটিয়ে যেতে পারে। তবে গরম আবহাওয়ার অন্যান্য উপাদান ভাইরাসটির অন্যান্য সুবিধা পাওয়া যেতে পারে। যেমন, মানুষ বাইরে বেশি সময় কাটানো সহায়ক হতে পারে। নানিয়াং টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক কার বলেন, মানুষজন বদ্ধ পরিবেশে বাস করা ভাইরাসটির জন্য সহায়ক। এতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটের একদল গবেষক অনুসারে, সূর্যের আলোয় থাকা আলট্রাভায়োলেট রশ্মি ভাইরাসটির জন্য ক্ষতিকর। তাই গরমকালে রোদ পড়ে এমন জায়গাগুলোয় সংক্রমণের ঝুঁকি কম থাকতে পারে। তবে এই ভাইরাসটি সাধারণত কোনো আক্রান্তের সংস্পর্শে আসার মাধ্যমে ছড়ায় বলে গরমে সংক্রমণ কমার সম্ভাবনা কম।

লকডাউন : 

গ্রিস ও ভিয়েতনামের মতো যেসব দেশ আগেভাগেই ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে কঠোর লকডাউন জারি করেছে, সেসব দেশে সংক্রমণের হারও সীমিত রয়েছে। এতে ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লকডাউন যে কার্যকর তার প্রমাণ পাওয়া যায়।

ইবোলা, এচইআইভির মতো প্রাণঘাতী ভাইরাস মোকাবিলার অভিজ্ঞতা আফ্রিকার জন্য করোনা মোকাবিলায় সহায়ক হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে। আফ্রিকান দেশগুলো ভাইরাসটি নিয়ন্ত্রণে তুলনামূলক দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো পদক্ষেপ নেয়ার বহু আগে থেকেই সিয়েরা লিয়ন ও উগান্ডার মতো দেশগুলো বিমানবন্দরে যাত্রীদের তাপমাত্রা মাপার ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। সেনেগাল ও রুয়ান্ডা আগেভাগেই তাদের সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছে ও কারফিউ জারি করেছে। এসব দেশে সংক্রমণ এখনো খুবই সীমিত। ২০১৪ সালে ইবোলা মহামারির সময়ে ঠিক করা প্রোটোকল মেনে তাৎক্ষণিকভাবে রোগটি শনাক্ত করেছে সিয়েরা লিয়ন। দেশজুড়ে জরুরি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কেন্দ্র স্থাপন করেছে দেশটির সরকার। ১৪ হাজার কমিউনিটি স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ দিয়েছে। এদের মধ্যে ১ হাজার ৫০০ জনকে আক্রান্তের সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের সংখ্যা ১৮০ জনেরও কম।

ইবোলা আক্রান্ত অপর এক উগান্ডাও করোনা মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে। বহিরাগতদের তাৎক্ষণিকভাবে কোয়ারেন্টিন করেছে সরকার। প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ট্রাক চালককে পরীক্ষা করা হচ্ছে সেখানে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে আক্রান্তের বেশিরভাগই অন্যান্য দেশ থেকে আগত।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, ধর্মীয় জমায়েত, ক্রীড়া অনুষ্ঠানের উপর বিধিনিষেধ করোনা মোকাবিলায় স্পষ্টত কার্যকর। প্রায় একমাস ধরে সীমান্ত, স্কুল ও বেশিরভাগ ব্যবসা বন্ধ রাখার পর জর্ডান ও থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোয় সংক্রমণ কমেছে। অন্যদিকে মধ্য প্রাচ্যের বেশিরভাগ দেশই বেশ আগেভাগে মসজিদ, মন্দির ও গীর্জার মতো অন্যান্য উপাসনালয় বন্ধ করে দিয়েছে। এতে নিশ্চিতভাবেই সফলতা দেখা গেছে।

তবে মধ্যপ্রাচ্যে ব্যতিক্রম দেখা গেছে ইরানে। সেখানে প্রথম করোনা আক্রান্ত শনাক্তের প্রায় এক মাস পর পর্যন্ত খোলা ছিলো দেশের সবচেয়ে বড় কিছু ধর্মীয় স্থান ও উপাসনালয়। দেশটির পবিত্র শহর কওমে প্রথম করোনা আক্রান্ত ধরা পড়ে। সেখান থেকে অচিরেই দেশজুড়ে ও পাশ্ববর্তী দেশগুলোয় এর সংক্রমণ ঘটে।

এছাড়া নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানও লকডাউনে ব্যাপক সফলতা পেয়েছে। টানা লকডাউনের কার্যকারিতা ভোগ করছে ইতালি, স্পেনের মতো একসময় করোনার প্রাণকেন্দ্র থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোও।

এদিকে, লকডাউন কার্যকর হলেও সামাজিক নিরাপত্তার ঘাটতি থাকা দেশগুলোর জন্য এর যথোপযুক্ততা প্রশ্নবিদ্ধ। যেসব দেশের বেশিরভাগ জনসংখ্যা ইনফর্মাল অর্থনীতির অধীনে কাজ করে, সেসব দেশে ব্যবসা বন্ধ কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। সেসব দেশে মানুষজনকে সামাজিক দূরত্ব ও পরিবারের জন্য খাদ্য জোগানের মধ্যে যেকোনো একটা বেছে নিতে বাধ্য হয় কঠোর লকডাউনে। আবার লকডাউন দেরিতে দেয়া ও শিথিল প্রয়োগে এর কার্যকারিতা কমে যায়।

সবশেষে, বেশিরভাগ বিশেষজ্ঞের মত হচ্ছে, করোনার প্রাদুর্ভাব কম বা বেশি হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো একক কারণ নেই। এর পেছনে, উপরে উল্লিখিত একাধিক বিষয় একসঙ্গে কাজ করতে পারে।