প্রচ্ছদ সারাদেশ হরিরামপুরে বন্যায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মানবেতর জীবনযাপন

হরিরামপুরে বন্যায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মানবেতর জীবনযাপন

জ.ই. আকাশ (হরিরামপুর) :

মানিকগঞ্জের হরিরামপুরে বন্যার পানি মৃদু কমতে শুরু করলেও দুর্ভোগ থেকে জনগণের মুক্তি মিলছে না সহসাই। গত কয়েকদিনে পদ্মা-যমুনার অব্যাহত পানি বৃদ্ধির ফলে হরিরামপুর উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে।

উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগের প্রধান সড়ক পানিতে ডুবে যাওয়ায় বিভিন্ন স্থানে রাস্তা ধসে গেছে। সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হওয়ায় উপজেলার সাথে বিভিন্ন ইউনিয়নের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

এছাড়াও জেলা শহরের সাথেও যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে এই উপজেলাটির। পানিবন্দী হয়ে চরম দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় ২০ হাজারের অধিক পরিবার। পথঘাট ডুবে যাওয়ায় নৌকা আর কলা গাছের ভেলাই যেন দুর্গত মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম।

১৪,৫৮৬ হেক্টর আবাদি জমির পুরোটাই এখন পানির নীচে। ফলে রোপা আমনসহ বিভিন্ন ফসলাদি ডুবে যাওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপজেলার কয়েক হাজার কৃষক। এছাড়া মৎস্য ঘের ভেসে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে অনেক মৎস্যচাষীরাও। পদ্মা-যমুনা-ইছামতির অববাহিকায় অবস্থিত এই হরিরামপুর উপজেলা। ২৪৫.৪২ বর্গকিলোমিটারের আয়তনে ২৫০টি গ্রামের অধিকাংশই বন্যায় প্লাবিত হয়েছে।

ছোট বড় ২৬টি হাটবাজারের প্রতিটি বাজারেই পানি উঠায় ব্যবসা-বানিজ্যসহ স্বাভাবিক জীবনযাপনে মানুষজন নাজেহাল হয়ে পড়েছে। করোনাকালীন ক্রান্তিকালে রোজার ঈদে ব্যবসায়ীরা ক্ষতির সম্মুখীন হলেও আশায় স্বপ্ন বুনতে থাকে কোরবানীর ঈদ নিয়ে। কিন্তু বর্তমান করোনা পরিস্থিতি কিছুটা শিথিল থাকলেও বন্যার কারণে হাটবাজারে পানি উঠায় এই কোরবানী ঈদেও ধরাশায়ী কয়েক হাজার ব্যবসায়ী। ফলে অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েন তারা।

শুধু তাই নয়, করোনাকালীন দুঃসময়ের পাশাপাশি এখন বন্যার কারণেও কর্মহীন অসহায় হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার মানুষ। মাত্রাতিরিক্ত বন্যার ফলে কোরবানীর গরু বিক্রি নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছে উপজেলার খামারিরা। ঐতিহ্যবাহী ঝিটকা গরুর হাট বন্যার পানিতে ডুবে যাওয়ায় ঝিটকা হাই স্কুলের মার্কেটের সামনে গরুর হাট মেলালেও চারিদিকে বন্যার পানির কারণে পর্যাপ্ত পরিমাণে গরু হাটে আনতে পারছে না খামারীরা। ফলে কোরবানীর গরু নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন তারা।

কোরবানীর গরুর ক্রেতারাও পড়েছেন বিপাকে। উপজেলার বিভিন্ন বাজারের পানি বন্দি ব্যবসায়ীরা জানান, ‘মহামারী করোনার সমস্যা না কাটতেই এবার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য শেষ হয়ে গেল। হাজার হাজার টাকা বিনিয়োগ করে এখন পরিবার পরিজন নিয়ে বসে বসার উপক্রম হয়েছে।’

এ ব্যাপারে ঝিটকা বাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি বেলায়েত হোসেন জানান, ‘হরিরামপুর তথা মানিকগঞ্জের মধ্যে ঝিটকা বাজার একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার হিসেবে পরিচিত। বন্যার পানি বাজারের অধিকাংশ জায়গায় প্রবেশ করায় ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। সামনে একটা ঈদ। সব ব্যবসায়ীর আশা থাকে সারাবছর যাই হোক, এই ঈদের বাজারে তাদের ভাল বেচাকেনা হবে। কিন্তু বন্যার কারণে বাজারে মানুষজনই আসতে পারছে না। বেচাকেনা আর হবে কি? এছাড়া গরুর হাটে পানি আসায় ঠিক মতো গরুর হাটও মিলাতে পারছি না।’

এ উপজেলার চরাঞ্চলসহ বিভিন্ন ইউনিয়নে বন্যা দুর্গতদের মাঝে মানিকগঞ্জ-২ আসনের সাংসদ মমতাজ বেগম ও মানিকগঞ্জ জেলা প্রশাসক এস এম ফেরদৌস, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মানবিক সহায়তার ত্রাণ বিতরণ করেন।’ মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের আয়োজনে পুলিশ সুপার রিফাত রহমান শামীম ‘ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ (আইজিপি) ড. বেনজির আহমেদ বিপিএম (বার) এর পক্ষ থেকে ২০০ পরিবার ও রেক্টর পুলিশ স্টাফ কলেজ এর এডিশনাল আইজি শেখ মোঃ মারুফ হাসান বিপিএম, পিপিএম এর ব্যক্তিগত তহবিল থেকে ১০০ পরিবারের মাঝে ত্রান সামগ্রী বিতরণ করেন।’

হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মানিকগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক দেওয়ান সাইদুর রহমান জানান, ‘মানিকগঞ্জ জেলার পদ্মা অধ্যুষিত সবচেয়ে নিচু এলাকা এই হরিরামপুর উপজেলা। এবারের বন্যায় উপজেলার অধিকাংশ এলাকাই প্লাবিত হয়েছে। বানের পানিতে ভাসছে ১৩টি ইউনিয়নের প্রায় লক্ষাধিক মানুষ।

কষ্টকর হয়ে পড়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। রাস্তাঘাট ডুবে উপজেলার সাথে সকল ইউনিয়নেরই যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে।বন্যা মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে তাঁর মানবিক সহায়তায় উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের বন্যা দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হচ্ছে। এছাড়াও সরকারিভাবেও উপজেলা প্রশাসনের অধীনে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণ সামগ্রী বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

বন্যায় বিভিন্ন এলাকায় অনেক রাস্তাঘাট ভেঙে গেছে।বন্যা পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট সংস্করণ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করব। আমি চাই, এই হরিরামপুরের একটা মানুষকেও যেন কষ্ট করতে না হয়। সে জন্য সকলের সহযোগিতা ও দোয়া চাই।’

এ ব্যাপারে হরিরামপুর উপজেলার সহকারি কমিশনার (ভূমি) মোঃ বিল্লাল হোসেন জানান, ‘ধীরে ধীরে বন্যার পানি কমতে শুরু করায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। তা সত্ত্বেও, সরকারি ত্রাণ-সহায়তা অব্যাহত আছে। উপজেলার ১৩টি ইউনিয়নে এ পর্যন্ত ৬০ মেট্রিক টন জি আর এর চাউল, ৮০০ প্যাকেট শুকনো খাবার এবং নগদ ৫০,০০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ৫০ মেট্রিক টন চাউল বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়াও, গবাদি পশুর খাদ্যের জন্য ১ লাখ টাকা এবং শিশু খাদ্যের জন্য ৫০,০০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।’