প্রচ্ছদ খেলাধুলা মেসিদের জন্য একজন ব্রাজিল ভক্তের ভালোবাসা

মেসিদের জন্য একজন ব্রাজিল ভক্তের ভালোবাসা

ব্রাজিল ভক্তরা কি মেসিকে কিংবা আর্জেন্টিনা টিমকে ভালোবাসতে পারে? কী অদ্ভুত প্রশ্ন! এও কী সম্ভব! মেসি এবং তাঁর টিমমেটরা যদি লাখ লাখ ডলার লস দিয়ে, নির্যাতিত ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভালোবাসা দেখিয়ে অত্যাচারী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে ফ্রেন্ডলি ম্যাচ বাদ দিতে পারে, তাহলে আমার, আপনার কী করা উচিত? আমাদের উচিত লিওনেল মেসিসহ আর্জেন্টিনার পুরো টিম, পুরো ফুটবল সংস্থা, সরকার ও জনগণকে ভালোবাসা দেয়া এবং শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা।

ম্যাচ বাতিলের ক্ষেত্রে অফিসিয়ালি আর্জেন্টিনা হয়ত নিরাপত্তার কথা বলছে, কিন্তু নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকি যে মেসিদের ছিল না, সেটি আমরা সকলেই জানি। ফিলিস্তিনিরা বরাবরই নির্যাতিত আর ইসরায়েলিদের হাত বরাবরই ফিলিস্তিনিদের রক্তে রঞ্জিত। ফিলিস্তিনিদের পক্ষ থেকে মেসিদের আক্রান্ত হওয়ার কোনও সুযোগ বা সামর্থ্য যে নেই, এ কথা সকলেই মানবেন। ফলে ইসরায়েলের সাথে ম্যাচ খেললে মেসি বাহিনীর কোনো ধরণের নিরাপত্তা ঝুঁকি হত না। বরং ম্যাচ বাতিল করায় মেসিদের বিপদ এখন বেড়ে গেল। কারণ ইসরায়েলকে খেপানো মানে নিজেদের বিপদ ডেকে আনা। ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ পৃথিবীর যে কোনো স্থানে যেকোনো নাশকতা করার সামর্থ্য রাখে।

এমনিতে আমি টিম ব্রাজিলের ভক্ত। সারাবিশ্বে ব্রাজিলের কোটি কোটি ভক্ত রয়েছে। এরা সবাই চাইবে ব্রাজিল বিশ্বকাপ জিতুক। আর্জেন্টিনার ভক্তরা চাইবে তাদের দল জিতুক। এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বিশ্বকাপ শুরুর আগে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র ইসরায়েলের সাথে ম্যাচ বাতিল করে মেসিবাহিনী এমনই বড় কাজ করেছে যে, এই দলের এখন বিশ্বকাপ জেতায়, না জেতায় কিছু যায় আসে না, অন্তত আমার কাছে। সারাবিশ্বের মানবতাবাদী কোটি কোটি মানুষের হৃদয় যে জিতে নিয়েছে মেসি ও তার দল। মানুষের হৃদয় থেকে কি একটা বিশ্বকাপ বড় হতে পারে? মেসিদের প্রতি তাই আমাদের অন্তহীন ভালোবাসা।

ইসরায়েলের সঙ্গে প্রীতি ম্যাচ নিয়ে বেশ অপ্রীতিকর অবস্থায় ছিলেন আর্জেন্টিনার ভক্তরা। অস্বস্তির মধ্য দিয়ে কয়েকটি দিন পার করতে হয়েছে তাদেরকে। ম্যাচটি হয়ে গেলে, লজ্জায় মুখ দেখাতে পারতেন না আর্জেন্টিনা ভক্তরা। ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের দখলকৃত স্থানে ফুটবল ম্যাচ খেলতে যাওয়া মানে এই গায়ের জোরে চলা অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়া। মেসিরা যদি খেলতে যেতেন, তাহলে চলমান গণহত্যাকেও বৈধতা দেয়া হত। এটা যে কোনও হৃদয়বান, বিবেকবান ও মানবতাবাদী আর্জেন্টাইন ফুটবল ভক্তের জন্য খুব দুঃখজনক হত। অবশেষে সেই দুঃখ পেতে হয়নি আর্জেন্টাইন ফুটবল ভক্তদের। মেসিরা প্রমাণ করে দিয়েছেন, এরা শুধু ভালো ফুটবলই খেলেন না, মানুষ হিসেবেও অতি উচ্চ মানের।

এমনিতে মনে হতে পারে, একটা ম্যাচ বাতিল হয়েছে, এতে এত উৎফুল্ল হওয়ার বা ব্যথিত হওয়ার কী আছে! বিশ্বকাপের আগে ইসরায়েলের সঙ্গে আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে ম্যাচ বাতিল হওয়ার তাৎপর্য টাকায় হিসেব করা যাবে না। এরপরেও টাকার একটা হিসেব তো থেকেই যায়। মেসি যদি এই ম্যাচ খেলতেন, তাহলে প্রতি মিনিটে কত টাকা পেতেন জানেন? ৫০ হাজার ডলারকে ৮০ টাকা দিয়ে গুণ করে হিসেব বের করুন। এক মিনিটে ৪০ লাখ টাকা! খেলা হত ৯০ মিনিটের।

আর্জেন্টাইন সাংবাদিক রয় নেমার আর্থিক ক্ষতির এই হিসেব জানিয়ে টুইট করেছেন। ম্যাচটি আয়োজনের জন্য ইতোমধ্যে ১ লাখ মিলিয়ন ডলার দেয়া হয়েছিল। চুক্তি ছিল আরও তিন মিলিয়ন ডলার দেয়া হবে আর্জেন্টিনাকে। এখন ম্যাচ বাতিলের ফলে আর্জেন্টিনা এই তিন মিলিয়ন ডলার তো পাবেই না, বরং এক লাখ ডলারও ফেরত দিতে হবে। এদিকে আর্জেন্টিনার বিরুদ্ধে নানা ধরনের হুমকি-ধামকি দিচ্ছে ইসরায়েল। মামলা তো আছেই, নানাভাবে দেখে নেয়ারও হুমকি পর্যন্ত দেয়া হয়েছে।

ম্যাচ বাতিলের পরে ইসরায়েলের অধিকর্তাদের প্রতিক্রিয়া শুনলেই বোঝা যায়, কত বড় ক্ষতি হয়েছে বিতর্কিত রাষ্ট্রটির। ইসরায়েল আসলে পরাজিত হয়েছে মানবতার কাছে, কূটনীতির কাছে। অস্ত্রের জোরে মানুষকে হত্যা করা যায়, কিন্তু মানুষের মন জয় করা যায় না, এই অমোঘ বাণীকেই যেন আবারো প্রমাণ করল আর্জেন্টিনা।

ইসরায়েলের সংস্কৃতিমন্ত্রী মিরি রেজেভ এতটাই খেপেছেন যে, উল্টো ফিলিস্থিনিদেরকেই তিনি সন্ত্রাসী হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এই ম্যাচ বাতিলকে তিনি ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিকে ইসরায়েলি অলিম্পিয়ানদের হত্যার সঙ্গে তুলনা করেছেন।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট মাওরিসিও মাক্রিকে আহবান জানিয়েছেন যথোচিত হস্তক্ষেপ করার জন্য।

এদিকে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী এভিগডোর লিবারম্যান বলেছেন, ‘এটা দুঃখজনক যে আর্জেন্টিনা ইসরায়েল বিরোধীদের চাপ মোকাবেলা করতে পারল না। ইসরায়েল বিরোধীরা বরাবরই ইসরায়েলের প্রতিরক্ষার অধিকারকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায় এবং এর ধ্বংস কামনা করে’।

ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট রিউভেন রিভলিন বলেছেন, ইসরায়েলের ক্রীড়াভক্তদের জন্য এই সকাল খুব দুঃখের। এমনকি ইসরায়েলের অনাগত প্রজন্মও কষ্ট পাবে ভবিষ্যতে এই খবর জেনে। তবে আমাদের কিছু মূল্যবোধ আছে, যেগুলো এমনকি মেসি থেকেও দামী’।

তবে ইসরায়েল সরকারের সমালোচনা সেদেশের ভেতর থেকেও হচ্ছে। সরকারবিরোধীরা বলছে, ম্যাচটি পূর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হাইফা নগরীতে হলে আর্জেন্টিনা হয়ত ম্যাচটি বাতিল করত না। জেরুজালেম নগরীতে ম্যাচ আয়োজন করতে গিয়ে সরকার বেশি রাজনীতি করে ফেলেছে বলে অভিযোগ করেছে বিরোধীরা।

১৯৬৭ সালে আরব যুদ্ধের সময় ইসরায়েল পূর্ব জেরুজালেম দখল করে নেয়, যদিও এর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায়নি। ইসরায়েল মনে করে পুরো শহর এর রাজধানী, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিরা তাদের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রের জন্য পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী হিসেবে দেখতে চায়।

ফিলিস্তিন ফুটবল এসোসিয়েশন আর্জেন্টিনার ফুটবল কর্তৃপক্ষের উপর খুব সন্তুষ্ট। ফিলিস্তিন ফুটবল এসোসিয়েশন এর প্রধান জিব্রিল রাজৌব বলেছেন, ম্যাচ বাতিল করে আর্জেন্টিনা মূলত ইসরায়েলকে লাল কার্ড দেখিয়েছে।

তবে ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের প্রতি ফুটবল গ্রেট লিওনেল মেসির ভালোবাসা প্রদর্শন এই প্রথম নয়। ২০১৪ সালে ইউনিসেফ এর গুডউইল অ্যাম্বাসেডর হিসেবে মেসি একজন আহত ফিলিস্তিনি শিশুর ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে নির্যাতন বন্ধের আহবান জানিয়েছিলেন।

ইসরায়েলের সঙ্গে ম্যাচ না খেলতে ফিলিস্তিন ফুটবল ফেডারেশনের পক্ষ থেকে বিশেষ করে মেসিকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল। সেই অনুরোধেই ইতিবাচক সাড়া দেন মেসি এবং তার সতীর্থরা।

এ বিষয়ে আর্জেন্টিনার স্ট্রাইকার গঞ্জালো হিগুয়িন ইএসপিএনকে বলেছেন, ‘কমনসেন্স এবং শরীর-স্বাস্থ্য সবকিছুর আগে বিবেচ্য বিষয়। আমরা মনে করেছি, ইসরায়েলে গিয়ে ম্যাচ খেলা আমাদের উচিত হবে না’।

রাশিয়া বিশ্বকাপে আইসল্যান্ডের বিরুদ্ধে ১৬ জুন প্রথম ম্যাচ খেলবে আর্জেন্টিনা। জুনের ২১ তারিখ ক্রোয়েশিয়া এবং ২৬ তারিখ নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে খেলবে মেসির দল। ইসরায়েলের সঙ্গে ম্যাচ বাতিল করে দেয়ায় আপাতত আর্জেন্টিনার প্রস্তুতি ম্যাচ বলে কিছু থাকল না। প্রস্তুতি ম্যাচ ছাড়া বিশ্বকাপে যাওয়া খেলোয়াড়ি দৃষ্টিকোণ থেকেও কম ক্ষতির নয়।