প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ প্রথম উড়াল রেলপথ বসছে জুনে

প্রথম উড়াল রেলপথ বসছে জুনে

মূল সড়কের মধ্য অংশে সড়কদ্বীপের চিহ্ন নেই। উঠছে একের পর এক পিলার। রাস্তার কোনো অংশ বন্ধ। চলতে হচ্ছে অন্য দিক দিয়ে। নির্মাণসামগ্রী, ঘিরে রাখা সীমানা, ছুটে চলা যান, এক্সকাভেটরের শব্দ জানান দেয় মহা এক কর্মযজ্ঞের।

নির্মাণের এই মহাযজ্ঞে স্থানে স্থানে দৃশ্যমান ছাইরঙা সব খুঁটি। মাটি থেকে ১৩ মিটার উঁচু এই খুঁটির ওপর দিয়েই ছুটে চলবে ছয়টি ট্রেন। প্রতিদিন পরিবহন করবে পাঁচ লাখ যাত্রী।

► উত্তরা-আগারগাঁওয়ে এগিয়েছে ৩৫% কাজ
► খুঁটি বসানো হয়েছে ৭০ শতাংশ
► হচ্ছে ৯টি স্টেশন
► থাকছে মেট্রো রেল পুলিশ

বাংলাদেশের প্রথম উড়াল মেট্রো রেল (এমআরটি-লাইন-৬) হচ্ছে উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে মতিঝিলে বাংলাদেশ ব্যাংক ভবনের সামনের অংশ পর্যন্ত। প্রায় ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ রেলপথের

প্রথম অংশ উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশ পর্যন্ত বর্তমানে চোখে পড়তে শুরু করেছে।

গত সপ্তাহেও নির্বাচন নিয়ে যখন সবাই ব্যস্ত তখনো চলেছে এর কাজ। কয়েক শিফটে ভাগ করে ২৪ ঘণ্টা চলছে এই নির্মাণযজ্ঞ। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, আগারগাঁওয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের সড়কের কাছ থেকে শেওড়াপাড়া পর্যন্ত খুঁটি উঠে গেছে।

জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) অর্থায়নে প্রকল্পের কাজ চলছে। ব্যয় হবে সব মিলিয়ে ২২ হাজার কোটি টাকা। ঢাকার প্রথম মেট্রো রেল এটি। এটি বাস্তবায়ন করছে ডিএমটিসিএল (ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কম্পানি লিমিটেড)।

ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সাবেক সচিব এম এ এন ছিদ্দিকের কাছে জানতে চাইলে তিনি গতকাল বিকেলে প্রকল্পের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৩৫ শতাংশ।

মাটির নিচে বিভিন্ন সংস্থার লাইন সরানোর কাজ, পাইলিংসহ সব ধরনের কাজ শেষ হয়ে গেছে। মাটির ওপরের খুঁটির ভিত্তি বা পিয়ার ক্যাপ, ভায়াডাক্ট নির্মাণের কাজ চলছে। উত্তরায় এ পর্যন্ত এক হাজার ১২৫ মিটার ভায়াডাক্ট নির্মাণ করা হয়েছে। পুরো প্রকল্পে নির্মাণ করা হবে প্রায় চার হাজার মিটার। খুঁটি বসানো হবে ৭৪৪টি। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ খুঁটি বসানোর কাজ শেষ হয়ে গেছে।’

তিনি জানান, আগামী জুন মাসের শেষ দিকে বা জুলাই মাসের প্রথম দিকে রেলপথ বসানোর কাজ শুরু হবে। প্রায় ৪৪ কিলোমিটার রেলপথ বসাতে হবে প্রায় ১১ কিলোমিটার রেলপথ তৈরির জন্য। আসা-যাওয়ায় ট্রেন চলাচল করবে ছয়টি। জাপানের কাওয়াসাকি-মিত্সুবিশি কনসোর্টিয়াম ট্রেনগুলো তৈরি করছে। এ কাজের অগ্রগতি হয়েছে ২০ শতাংশ। প্রথম ধাপের কাজ শেষ হবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে। এর দুই মাস আগে ট্রেন আনা হবে। এসব ট্রেন সাধারণ ট্রেনের চেয়ে ভিন্ন। তিন মিনিট পর পর এগুলো চলাচল করবে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও অংশে থাকবে ৯টি স্টেশন। এগুলো হবে দোতলা। এসব রেলস্টেশন তৈরির জন্য মাটির নিচের কাজ শেষ হয়েছে। ভবন তুলতে তিন মাসের বেশি সময় লাগবে না। ভায়াডাক্ট নির্মাণের কাজ শেষ হলে স্টেশন ভবন তোলার কাজ শুরু করা হবে।

জানা গেছে, জাপানের কাওয়াসাকি-মিত্সুবিশি কনসোর্টিয়াম ট্রেনগুলো তৈরি করছে। এসব ট্রেনের কোচে থাকছে লাল-সবুজের আধিক্য। প্রতিটি কোচ হবে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। প্রতিটি ট্রেনে থাকবে ছয়টি বগি। এসব বগিতে যাত্রী ধারণক্ষমতা এক হাজার ৭৩৮ জন। বগির উভয় পাশে থাকবে চারটি দরজা। বগিগুলোতে আসন হবে লম্বালম্বি। প্রতিটি বগিতে দুটি হুইলচেয়ার থাকবে।

মেট্রো রেল পরিচালনার জন্য মেট্রো রেল পুলিশ নিয়োগ করা হবে। এর জন্য এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। বলা হয়েছে, একজন অতিরিক্ত আইজিপি পুরো নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখভাল করবেন। প্রতিটি রেলপথের দেখভালের দায়িত্বে থাকবেন একজন ডিআইজি। এর জন্য পুলিশ সদস্যদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।

সূত্র জানায়, এসব ট্রেন চলবে বিদ্যুতে। এ জন্য উত্তরায় বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। সব মিলিয়ে তিনটি উপকেন্দ্র থাকবে। জাতীয় গ্রিড থেকে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে। উত্তরা তৃতীয় পর্বে ডিপো নির্মাণের জন্য ২৩ দশমিক ৮৪ হেক্টর জমি রাজউক থেকে বরাদ্দ পাওয়া গেছে।

২০১৬ সালের ২৭ মার্চ জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সঙ্গে ডিএমটিসিএলের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। প্রতিষ্ঠানটি ভূমি উন্নয়নের কাজ শুরু করে শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। সেখানে গত বছরই ওঠানো হয়েছে ভায়াডাক্ট। উত্তরার তৃতীয় পর্বে ভূমি উন্নয়ন ছাড়াও ভায়াডাক্ট নির্মাণের কাজ অব্যাহত আছে। তবে বেশি কাজ চলছে মিরপুর-১২ থেকে আগারগাঁও অংশে। এর মধ্যে আগারগাঁও থেকে শেওড়াপাড়া অংশে কর্মযজ্ঞের নিদর্শন বেশি চোখে পড়ছে।

গতকাল সরেজমিনে শেওড়াপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, সারি সারি খুঁটি উঠে গেছে। কোথাও চলছে ঢালাইয়ের কাজ। রাজধানীর মিরপুর প্রান্ত থেকে বিভিন্ন প্রান্তে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক নগর পরিবহনের বাস চলাচল করে। প্রকল্পের কাজের জন্য রাস্তার লেন বন্ধ থাকায় এসব বাস ভিড় করে আছে স্থানে স্থানে। নির্মাণকাজের কারণে বিশেষ করে আগারগাঁও মোড়ে থমকে যায় সময়। বিকেলে শিকড় পরিবহনের বাসে যানজটে আটকে পড়া যাত্রী আরশ আলী বলেন, ‘প্রতিদিন দেখি পিলার উঠতাছে। কষ্ট হচ্ছে যানজটে, তবে আর বেশিদিন কষ্ট করতে হইব না।’

প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানান, উত্তরা তৃতীয় পর্ব থেকে আগারগাঁও অংশে মেট্রো রেল চলতে শুরু করবে আগামী ডিসেম্বরে। তিন মিনিট ৩০ সেকেন্ড পর পর ট্রেন ছাড়বে স্টেশন থেকে। প্রতিটি ট্রেনের গতি হবে ৩২ কিলোমিটার। প্রতিদিন সকাল ৬টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত চলবে ট্রেনগুলো। প্রতিটি স্টেশনে যাত্রী ওঠানামা করতে ট্রেন বিরতি দেবে ৪০ সেকেন্ড। যাত্রীরা ফুটপাত থেকে সিঁড়ি, এসকেলেটর কিংবা লিফটে উঠতে পারবে ট্রেনে।

বিশ্বের ৫৫টি দেশের ১৪৮টি নগরীতে মেট্রো রেল ব্যবস্থা রয়েছে। রাস্তার ওপর চাপ কমিয়ে নিরাপদ ও দ্রুত গনপরিবহনের এই ব্যবস্থায় ১৪৮টি নগরীর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিবেশী ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, কলকাতা নগরী। চীনের বেইজিং ছাড়াও সাংহাইয়ে ধাপে ধাপে চালু হয়েছে মেট্রো রেল। ঢাকার কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা এসটিপিতে পাঁচটি পথে মেট্রো রেল চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এর একটি হলো উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত, যা বাস্তবায়নের কাজ দ্রুত এগোচ্ছে।

প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, এই রুটে মেট্রো রেল চালু হলে দুই দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন করা সম্ভব হবে।–কালেরকন্ঠ