প্রচ্ছদ রাজনীতি খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ

খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ

কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া খুবই অসুস্থ। গতকাল পুরান ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ জজ আদালতে নাইকো মামলায় হুইল চেয়ারে করে তাকে হাজির করা হলে তিনি আদালতে উপস্থিত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আইনজীবীদের তার অসুস্থতার কথা জানান। গতকাল দুপুর ১২টা ৩৪মিনিটে হুইল চেয়ারে করে খালেদা জিয়াকে আদালতে উপস্থিত করে কারা কর্তৃপক্ষ। এজলাসে প্রবেশের সময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল তাকে সালাম দেন। এ সময় প্রসিকিউটর মোশাররফ হোসেন কাজল তার শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে বেগম খালেদা জিয়া তাকে বলেন, গত ধার্য তারিখে (২০ ফেব্রুয়ারি আদালতে আসার জন্য) তিনি তৈরি হয়ে বসেছিলেন। কারা কর্তৃপক্ষই তাকে আদালতে আনেননি। উল্টো অপপ্রচার করেছেন ঘুমে ছিলেন। এটা কেমন কথা হলো। এরপর তিনি তার চিকিৎসার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে বলেন, দিন দিন শরীর খুব খারাপের দিকে যাচ্ছে। শরীর কাঁপে, পা নাড়াতে পারেন না। আদালতে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকতে সমস্যা হয়। চিকিৎসার জন্য রক্ত নিতে যারা তার কাছে এসেছিলেন তারা তার শিরাই খুঁজে পান না। তার ব্যক্তিগত লোক আছে যারা এ বিষয়টি ভালো পারেন। তাদের আসার সুযোগ দিলে ভালো হয়। এ বিষয়টি তিনি আদালতে উপস্থাপন করতে তার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদারকেও পরামর্শ দেন।

আদালত থেকে বের হয়ে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার বিষয়ে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, খালেদা জিয়ার শরীর খুবই খারাপ। ডাক্তাররা এখন পর্যন্ত তার প্রোপার চিকিৎসা দিচ্ছেন না। মাত্র একবার এসে ডাক্তার তাকে দেখে গেছেন। এখন পর্যন্ত তার রক্ত নেয়া হয়নি। রক্ত পরীক্ষা করা হয়নি। ডায়াবেটিসের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তিনি বলেন, মামলাটি জামিনযোগ্য ধারায়। এই সময়ের মধ্যে তার জামিন পাওয়া উচিত। তিনি জামিন পাচ্ছেন না। এ বিষয়ে খালেদা জিয়া কনসার্ন। মামলাটি ব্যক্তিগত পর্যায়ে নেয়া হয়েছে।

অপর দিকে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, গত ২৪ ফেব্রুয়ারি সরকারের গঠন করা মেডিক্যাল বোর্ড এসে তার পরীক্ষা করেছে। মেডিক্যাল বোর্ডের বক্তব্য হলোÑ তার বাম হাত ও বাম পা অবস হয়ে গেছে। তিনি নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারেন না। অন্যের সাহায্য নিয়েও নিজের পায়ে তার হাঁটা সম্ভব নয়। তার রক্ত ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা হয়নি। মেডিক্যাল বোর্ড বলছে, অবিলম্বে খালেদা জিয়াকে বড় রকমের বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে হলে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি।

গতকাল দুপুর ১২টা ৩৪মিনিটে পুরান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থাপিত বিশেষ আদালত-৯-এর বিচারক শেখ হাফিজুর রহমানের আদালতে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা নাইকো মামলায় খালেদা জিয়াকে হুইল চেয়ারে করে হাজির করা হয়। আদালতে আনার পর উপস্থিত দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও আইনজীবীরা তার সঙ্গে কথা বলেন।

মামলার শুনানির একপর্যায়ে আদালত খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে যে আবেদন করা হয়েছে সে বিষয়ে আইনজীবীদের বক্তব্য জানতে চান। জবাবে খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, আমরা খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার বিষয়ে একটি আবেদন করেছি। আদালত এ বিষয় কোনো আদেশ এখনো দেননি। গত ২৪ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের একটি মেডিক্যাল টিম খালেদা জিয়াকে দেখেন। তার পর দিন খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসার প্রয়োজন মর্মে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, গত ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্যাটকো মামলায় হাজিরা দেয়ার জন্য কারাগার থেকে আলিয়া মাদরাসা মাঠ আদালতে গাড়িতে করে খালেদা জিয়াকে নেয়া হয়। গাড়ি থেকে নামার সময় খালেদা জিয়া পড়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় দুই পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরেন। এরপর হুইল চেয়ারে করে আদালতে নেয়া হয় তাকে। তাই সব মিলে তার চিকিৎসা প্রয়োজন। আগে চিকিৎসা পরে বিচার।

এরপর খালেদা জিয়ার আইনজীবীকে উদ্দেশ করে বিচারক বলেন, চিকিৎসার বিষয়ে তো উচ্চ আদালত একটি আদেশ দিয়ে দিয়েছেন। নিম্ন আদালত এ বিষয়ে কী করতে পারে?

এরপর বিচারক রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজলকে বলেন, এ বিষয়ে আপনি কিছু বলেন।

জবাবে মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, চিকিৎসার বিষয়টি জেল কোড আনুযায়ী হতে পারে। এ ছাড়া খালেদার পক্ষে আজ শুনানি, আজ শুনানি শুরু করলে ভালো হয়।

এ সময় বিচারক বলেন, চিকিৎসার বিষয়ে আপনাদের রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট একটি মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করেছেন। এর বাইরে কি আমার যাওয়ার এখতিয়ার আছে? আমি চিকিৎসার বিষয়ে আদেশ দিবো এবং আগামী ১৯ মার্চ এ মামলার পরবর্তী শুনানি হবে।
এরপর খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুদকার বলেন, জব্দকৃত আলামতের অধিকাংশই আমাদের দেয়া হয়েছে। কিছু এখনো বাকি আছে। যা পেলে আমরা অব্যাহতির আবেদন প্রস্তুত করতে পারব। তাই আজ সময় দিবেন।

চিকিৎসার বিষয়ে তিনি বলেন, ম্যাডাম অনেক অসুস্থ। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি গ্যাটকো দুর্নীতি মামলায় তাকে বকশিবাজারের আদালতে গাড়ি থেকে নামানোর সময় পড়েই গিয়েছিলেন। ভাগ্য ভালো দায়িত্বরতরা ধরে রক্ষা করেছেন। তা না হলে ওই দিন বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেতো। তাই আমাদের ব্যক্তিগত চিকিৎসক দিয়ে চিকিৎসা করার আদেশ দিবেন।

রোববার আদালতের কার্যক্রম শেষ হয় বেলা ১টা ৪৮ মিনিটে। এরপর আবারও খালেদা জিয়াকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। আদালত চলাকালীন খালেদা জিয়ার পাশে বসে তার সঙ্গে কথা বলেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খোলেদা জিয়াকে হাজির করার পর দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে আদালত বসেন। এ সময় মামলার আসামি জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সচিব খন্দকার শহীদুল ইসলামের পক্ষে তার আইনজীবী আসাদুজ্জামান অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদনের শুনানি করেন। তারপর সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনের পক্ষে তার আইনজীবী অব্যাহতি চেয়ে আবেদনের শুনানি করেন। তারা দু’জন শুনানি শেষে বলেন, মামলাটি চলতে পারে না।

এরপর মামলার আসামি বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ মামলার আইনি বিষয়ে তিনটি যুক্তি উপস্থাপন করে তার শুনানি শেষ করেন। তিনি বলেন, মামলায় আমার বিষয়ে কোনো কিছু নেই। নেই কোনো দলিল, সাক্ষী বা কোনো কাগজ। আমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব থাকাকালে শুধু মতামত দিয়েছি, যা সব সরকারের আমলে দেয়া হয়। খালেদা জিয়াও নিয়ম অনুযায়ী স্বাক্ষর দিয়েছেন। আগের প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি সচিবও এ কাজ করেছেন, যা চার্জশিট দেখে প্রতীয়মান হয়। আমি খালেদা জিয়াসহ সব আসামির অব্যাহতি চাচ্ছি।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ তার পক্ষে ল’ পয়েন্টের শুনানিকালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে নাইকো দুর্নীতির মামলা বাতিলের, খালেদা জিয়ার পক্ষে এয়ারবাস ক্রয়ে দুর্নীতির মামলা বাতিলের এবং ১৯৬৪ সালে বঙ্গবন্ধুর কয়লা আমদানি নিয়ে দুর্নীতি বাতিলের বিষয়ে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে শুনানি শেষ করেন।

গতকাল আদালতে খালেদা জিয়ার আইনজীবী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন প্রবীণ আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন, আব্দুর রেজাক খান, এ জে মোহাম্মদ আলী, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, মাসুদ আহমেদ তালুকদার, জয়নুল আবেদীন মেজবা, জিয়া উদ্দিন জিয়া প্রমুখ।

এর আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি অসুস্থ বেগম খালেদা জিয়া তার চিকিৎসার জন্য আবেদন করতে আইনজীবীদের পরামর্শ দেন। ওই দিন খালেদা জিয়াকে আদালতে আনার পর তার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, মাসুদ আহমেদ তালুকদার ও কায়সার কামাল তার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় খালেদা জিয়া তার অসুস্থতার কথা তাদের জানান। এরপর খালেদা জিয়া গুরুতর অসুস্থ উল্লেখ করে তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক দ্বারা চিকিৎসা করানোর জন্য আদালতে আবেদন করেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার। তিনি আদালতে বলেন, গত সেপ্টেম্বর মাসে হাইকোর্টের নির্দেশে বেগম খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) নেয়া হয়। কিন্তু চিকিৎসা অসমাপ্ত রেখে তাকে আবার কারাগারে আনা হয়। বর্তমানে উনার শারীরিক অবস্থা ভালো না। উনার শারীরিক সমস্যাগুলো বাড়ছে। তার চিকিৎসার ব্যাপারে হাইকোর্টের একটি আদেশ রয়েছে। এখন তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ তাই আমরা ব্যক্তিগত চিকিৎসক দ্বারা আবারও তাকে চিকিৎসা প্রদানের অনুমতি চেয়ে আবেদন করছি। জবাবে আদালত বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়ে হাইকোর্টের আদেশটি আদালতে দাখিল করেন। পরে আদেশ দেবো।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর খালেদা জিয়াসহ অন্যদের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় এ মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) । ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয়। মামলায় অভিযোগ করা হয়, ক্ষমতার অপব্যবহার করে তিনটি গ্যাসক্ষেত্র পরিত্যক্ত দেখিয়ে কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর হাতে তুলে দেয়ার মাধ্যমে আসামিরা রাষ্ট্রের প্রায় ১৩ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকার ক্ষতি করেছেন।