প্রচ্ছদ হেড লাইন কোভিড-১৯’র চিকিৎসায় যুক্ত নন এমন চিকিৎসকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়

কোভিড-১৯’র চিকিৎসায় যুক্ত নন এমন চিকিৎসকরাও আক্রান্ত হচ্ছেন করোনায়

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে অথবা উপসর্গ নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪১ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। যাদের একটি বড় অংশই সরাসরি কোভিড-১৯-এ আক্রান্তদের চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত নন। তারা কীভাবে এত আক্রান্ত হচ্ছেন?

সম্ভাব্য কারণ খুঁজছেন চিকিৎসকদের সংগঠন

চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন বলছে, সারা দেশে ১ হাজার ৩৫ জন চিকিৎসক করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকাতেই রয়েছেন প্রায় ৪০০জন।

সংগঠনটির মহাসচিব ডা. মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেছেন, সরাসরি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত নন, এমন চিকিৎসকদের আক্রান্ত হওয়ার ব্যাপারে তারা নিজেরা অনুসন্ধান করেছেন।

তারা কিছু সম্ভাব্য কারণ জানতে পেরেছেন, “যে চিকিৎসকেরা মারা গেছেন তাদের বেশিরভাগই বয়স্ক ছিলেন। আমরা খুঁজে দেখেছি তাদের পরিবারের আরও অনেক সদস্য, ছেলে, ছেলের বৌ, মেয়ে বা মেয়ে জামাই এরা পেশায় চিকিৎসক। তারা এক বাসায় থাকতেন। ওই চিকিৎসকেরা যখন তাদের কর্মস্থল থেকে ফেরত আসেন, সেখান থেকে একটা সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়ে যায়।”

তিনি জানিয়েছেন যে, কয়েকজনকে পাওয়া গেছে যাদের ভবনে, অন্য ফ্ল্যাটে করোনাভাইরাস আক্রান্ত পরিবার ছিল। ওই চিকিৎসকেরা তাদের ফ্ল্যাটেই চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। নিয়মিত সেসব প্রতিবেশীদের বাসায়ও যেতেন।

তিনি বলছেন, মৃত ডাক্তারদের অনেকের ক্ষেত্রে ‘কন্টাক্ট ট্রেসিং’ সঠিকভাবে করা হয়নি।

হিসেব কষলে দেখা যায়, বাংলাদেশে মোট যত ব্যক্তি কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন তার চার শতাংশ স্বাস্থ্যকর্মী। শুরুতে স্বাস্থ্যকর্মীদের যথেষ্ট এবং ভাল মানের সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হচ্ছিল না বলে নানা অভিযোগ উঠেছিল। সেই পরিস্থিতি এখন অনেকটা বদলে গেছে।

সাধারণ রোগীরা অনেকে লক্ষণ লুকাচ্ছেন?

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার একটি হাসপাতালের একজন সিনিয়র নার্স মনে করছেন, সাধারণ রোগীদের অনেকেই লক্ষণ লুকাচ্ছেন, যেটি কোভিড-১৯ এর চিকিৎসায় যুক্ত নন এমন স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমিত করতে পারে।

তিনি বলছেন, “যেমন জেনারেল কোন রোগীকে আমরা যদি জিজ্ঞেস করি কোন লক্ষণ আছে কিনা, করোনাভাইরাসের টেস্ট করিয়েছেন কিনা, তারা সেটা বলতে চায় না। সেটা হয়ত বা সংকোচ হতে পারে। অথবা তারা ভাবতে পারে বললে আমরা তাদের সেবা দেবো না। তারা কিছু তথ্য গোপন করে যায়।”

বিএমএ-র হিসেবে সারা দেশে নার্স আক্রান্ত হয়েছেন ৮৮৫ জন।

সংক্রমণ এড়াতে ইদানিং অনেক সাধারণ হাসপাতালে রোগীদের ভর্তি করার আগে করোনাভাইরাস পরীক্ষার নেগেটিভ সার্টিফিকেট চাওয়া হচ্ছে। উপসর্গ থাকলে তাদের হাসপাতালে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না।

কোভিড-১৯ চিকিৎসা দেয় না, এমন হাসপাতাল ঢাকার জাতীয় ক্যান্সার ইন্সটিটিউটে এ পর্যন্ত পাঁচজন চিকিৎসক কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হয়েছেন। হাসপাতালটির গাইনি অংকলজি বিভাগের প্রধান ডা. রোকেয়া আনোয়ার আরও দুটো সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করলেন।

রোগীর আত্মীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মীদের দ্বারাও কি ছড়াচ্ছে?

ডা. আনোয়ার বলছেন, “রোগীদের সাথে যে আত্মীয়রা অ্যাটেনডেন্ট হিসেবে আসে। তাদের আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। এখন একজন রোগীর সাথে যে অ্যাটেনডেন্ট আসতে দেয়া হচ্ছে, সেই অ্যাটেনডেন্ট আক্রান্ত কিনা, উপসর্গহীন কিনা সেটা কিন্তু আমরা বুঝতে পারছি না।”

তিনি আরও উল্লেখ করলেন হাসপাতালে যারা পরিচ্ছন্নতা সহ অন্যান্য ধরনের কর্মী রয়েছেন তারা যথেষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মানছেন কি না।

“তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর যে কর্মীরা রয়েছেন তারা বাড়িতে স্বাস্থ্যবিধি হয়ত মানছেন না। তাদের বাসায় হয়ত অনেক লোক আসে। পরদিন এভাবেই তারা কাজে আসছে। তাছাড়া তাদের যথেষ্ট সুরক্ষা সামগ্রী আমরা দিতে পারছি না। হয়ত মাসে তিরিশটা মাস্ক দেয়ার কথা কিন্তু দেয়া হচ্ছে কম। সেকারণে ওরা একই মাস্ক বারবার পরছে।”

এই কর্মীদেরই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা দরকার বলে মনে করেন ডা. রোকেয়া আনোয়ার। “ওরা যন্ত্রপাতি হ্যান্ডেল করে, টয়লেট পরিষ্কার করে, টেবিল, দরজার হাতল পরিষ্কার করে। যে জায়গাগুলোতে ভাইরাস থাকতে পারে, সেই জায়গাগুলোই কিন্তু ওরা পরিষ্কার করছে। ওদেরই সবচেয়ে বেশি সুরক্ষা লাগবে।”

তিনি যেমনটা বলছেন, বিএমএর হিসেবেও স্বাস্থ্যসেবায় জড়িতদের মধ্যে যারা আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও আয়াসহ হাসপাতালের অন্যান্য কর্মীদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। তাদের সংখ্যা ১৩শ ৫৪জন।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউটের ভাইরলজি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন বলছেন, রোগীর চাপ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির কথা।

তিনি বলছেন, “আমাদের হাসপাতালগুলোতে এখন ব্যাপক ভিড়। ‘কোভিড নন-কোভিড’ এক জায়গায় হয়ে যাচ্ছে। অধিক সংখ্যক মানুষকে চিকিৎসা দিতে হলে, কাজের চাপ বেশি থাকলে নিজের প্রতি যত্ন সেভাবে নেয়া যায় না। হয়ত গ্লাভস বা মাস্ক বদলানো দরকার, কিন্তু তিনি কাজের চাপে পারছেন না”

“এমন হতে পারে যে, সেগুলো হয়ত বদলাচ্ছেন, কিন্তু সেটিকে সুরক্ষিত জায়গায় ফেলছেন না। এই বন্দোবস্ত কিন্তু আমাদের দেশে বেশিরভাগ হাসপাতালেই নেই। একটা ওপেন ফ্লোরে যদি এসব সামগ্রী ফেলে দেন সেটাও সংক্রমণের উৎস হতে পারে।”

স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িতরা কমিউনিটি থেকেও আক্রান্ত হচ্ছেন কিনা, পরিচ্ছন্নতা কর্মী ও আয়াদের মাধ্যমে হাসপাতালে অন্যরা সংক্রমিত হচ্ছে কিনা, রোগী ও রোগীর আত্মীয়দের তথ্য লুকানো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব, আসলে কোন কারণ কতটা দায়ী সে নিয়ে কোন তথ্য নেই। সূত্র : বিবিসি