প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ কী অপরাধে কার পাপে এতো নবজাতক হত্যা, দায় নিবে কে ?

কী অপরাধে কার পাপে এতো নবজাতক হত্যা, দায় নিবে কে ?

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

রাজধানীসহ সারাদেশে চলতি মাস থেকে গত ৬ বছরে মোট ২১০টি নবজাতককে ডাস্টবিন, জঙ্গল ও রাস্তা থেকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ মামলা করায় অধিকাংশ নবজাতকের ময়নাতদন্তও হয়েছে। সেই ময়নাতদন্তের ওপর ভিত্তি করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি ডিএনএ প্রোফাইলও তৈরি করেছে। কিন্তু উন্নত দেশের মতো ডিএনএ ব্যাংক না থাকায় ডিএনএ ম্যাচ করানো সম্ভব হয়নি। আর তাই শেষ পর্যন্ত উদ্ধার হওয়া মৃত নবজাতকদের জন্মদাতা বা জন্মদাত্রী অদৃশ্যই থেকে গেছে।

নবজাতক হত্যা

প্রায়ই দেখা যায় অনাকাঙ্ক্ষিত নবজাতকের স্থান হয় ডাস্টবিন, ফুটপাত, ঝোপ-জঙ্গল, ট্রেনের বগি, শৌচাগার বা নালা-নর্দমায়। গত দুই মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থেকে ৪টি নবজাতক মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। যার তিনটির শরীরে পচন দেখা গেছে। এমনকি কাক ঠুকরেও খেয়েছে।

কার পাপে? কী অপরাধে? এই সুন্দর পৃথিবীর আলো চোখ মেলে দেখার আগেই তাদের চলে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে? 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি বছর শত শত ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ অথবা আইনের দৃষ্টিতে ‘অবৈধ’ সন্তানকে গোপনে হত্যা করা হচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। আমাদের দেশে বিয়ের আগে শারীরিক সম্পর্ক এবং গর্ভপাত নিষিদ্ধ। ফলে যখনই কোনো অবিবাহিত তরুণী গর্ভধারণ করে, তার পরিবারকে গ্রাস করে আতঙ্ক। শেষ পর্যন্ত এর সুরাহা হয় কোনো একটি ক্লিনিক কিংবা গোপন ফ্ল্যাটে৷ নিজের পেটে ধরা সন্তানকে হয়তো নিজের হাতেই মৃত্যুর পথে ঠেলে দেন অশ্রুসিক্ত সেই তরুণী মা!

প্রেমে উপেক্ষিত :

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক পুরোপুরি নিষিদ্ধ। ইসলামি শরিয়া আইনেও ব্যাভিচার বা বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ফলে কোনো অবিবাহিত মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়লে বিষয়টি জানার সঙ্গে সঙ্গে পরিবার ও সমাজ পেটে থাকা সন্তানটিকে হত্যা করতে মরিয়া হয়ে ওঠে। সম্প্রতি দেশে ধর্ষণের শাস্তি কড়াকড়ি করার পরও অবৈধ শারীরিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে মানুষ, বিয়ের আগেই অনৈতিক সম্পর্কে জড়াচ্ছে তারা।

বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও গোপন ফ্ল্যাটে গর্ভপাত :

রাজধানীর একটি হাসপাতালের নার্স সুস্মিতা শারমিনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, দেশের কতিপয় বেসরকারি হাসপাতালই নয়, বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতেও প্রতিদিন একাধিক গর্ভপাতের ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। এছাড়াও শহরের বিভিন্ন স্থানে রয়েছে ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে চলে এমন অপকর্ম।
প্রত্যন্ত অঞ্চলে গর্ভপাত বা নবজাতক হত্যার বহু ঘটনা ঘটলেও তা নজরে আসছে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

সোশাল মিডিয়া, ওটিটি প্ল্যাটফর্মের ভূমিকা:

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, আমরা এমন এক সমাজে বাস করি, যেখানে আমাদের ছেলে-মেয়েদের হাতে স্মার্ট ফোন ও ইন্টারনেট আছে, সেসবের মাধ্যমে তারা অশ্লীলতা দেখছে। বিদেশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং ওভার দ্যা টপ (ওটিটি) প্ল্যাটফর্মে অস্বাভাবিক কন্টেন্ট ও বিজ্ঞাপন প্রচার হয়ে থাকে। যা দেখে তারা কখনো কখনো সমাজের নিষেধাজ্ঞা না মেনে অস্বাভাবিক প্রেমে জড়িয়ে পড়ছে, যা খুশি তাই করছে৷ কিন্তু পরিবার যখন বিষয়টি জানতে পারছে, ততদিনে হয়ত মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে পড়েছে৷ কিন্তু এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।

নবজাতক হত্যা কত? কারা এর সাথে জড়িত:

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে উদ্ধার করা হয় ২১০টি নবজাতকের লাশ। এর মধ্যে ২০১৯ সালে উদ্ধার করা হয় ৪২টি লাশ। ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ৩টি নবজাতকের লাশ উদ্ধারের ঘটনা ঘটেছে।

ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ও পুলিশের ভাষ্য মতে, জন্ম নেওয়ার পর উঁচু ভবন থেকে নিচে ফেলায়, ডাস্টবিনে কুকুরের কামড়, কাপড় বা প্যাকেটে বদ্ধ অবস্থায় থাকায়, চুক্তিবদ্ধ ধাত্রীরা নাড়ি না কেটে ফেলে রাখায় কিংবা অনাহারে পড়ে থাকায় এসব শিশুর মৃত্যু হয়। এই নিষ্ঠুর হত্যার সঙ্গে জড়িত নবজাতকের মা-বাবা এবং কিছু মেটারনিটি ক্লিনিকের কর্মী। অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুকে নিয়ে সামাজিক হেনস্তার ভয়ে যারা এই নিষ্ঠুর কাজ করছেন, তারা একে হত্যাকাণ্ডই মনে করছেন না!

কেন বাড়ছে নবজাতক হত্যা, এর মূল কারণ কি?

সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা বলছেন, নীতি নৈতিকতা না মানা, ধর্মীয় অনুশাসনকে অবজ্ঞা করা এবং সচেতনতার অভাবে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ সন্তান জন্ম নিচ্ছে। পরে লোকলজ্জার ভয়ে তাদের হত্যা করা হচ্ছে।

রাজধানীতে ও ঢাকার বাইরে এমন হত্যার দৃশ্যপট:

রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় শহর এবং জেলা শহরগুলোতেই অনাকঙ্খিত গর্ভধারণ, গর্ভপাত এবং নবজাতক হত্যার ঘটনা বেশি ঘটে বলে জানা গেছে।

পুলিশের ভূমিকা:

পুলিশ সূত্র জানায়, কখনও নবজাতকের মা শনাক্ত হলে বেরিয়ে আসে মর্মস্পর্শী ঘটনা। নেহাত বিপদে পড়েই মা তার গর্ভের সন্তানকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেন। ২০১৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বেইলি রোডের একটি বাড়ির ৫ তলার বারান্দা থেকে নবজাতককে ফেলে দেন ওই ফ্ল্যাটের গৃহকর্মী কিশোরী মা বিউটি আক্তার (১৭)। হতভাগ্য সেই নবজাতকটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করা হলেও ২৫ দিন পর মারা যায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মা বিউটি আক্তার জানান, ঘটনার ১০ মাস আগে তিনি কুমিল্লায় বোনের বাসায় বেড়াতে গিয়ে ভগ্নীপতি কর্তৃক ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। যে কারণে তিনি গর্ভধারণ করেন এবং এই শিশুটির জন্ম হয়। লোকলজ্জার ভয়ে তিনি শিশুটিকে নির্মমভাবে বারান্দা থেকে ফেলে দেন।

এছাড়াও গত ৫ ডিসেম্বর (শনিবার) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জগন্নাথ হলের উল্টো পাশে অবস্থিত বুয়েট স্কুলের গেটের ডান পাশের ড্রেনের রাস্তার ওপর থেকে গামছা দিয়ে মোড়ানো অবস্থায় একটি মেয়ে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিলো।
একই বছরের (২০২০ সাল) ১০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের সামনের যাত্রী ছাউনি থেকে ১২ সপ্তাহ বয়সী একটি মানব ভ্রূণ উদ্ধার করা হয়েছিলো।

এসব ঘটনার বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে রাজধানীর শাহবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মামুন অর রশীদ বলেন, ‘এসব ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে অপমৃত্যুর মামলা করে, কিন্তু নবজাতকের মা-বাবার পরিচয় পাওয়া যায় না। আমরা রুটিন মাফিক লাশগুলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠাই।’

এদিকে সর্বশেষ গতকাল বুধবার (১৩ জানুয়ারি) লক্ষীপুর জেলার কমল নগরে সড়কের পাশে পড়ে থাকা কালো ব্যাগের ভেতর থেকে নবজাতকের লাশ টানাহেঁচড়া করে বাইরে নিয়ে আসছিলো একটি কুকুর। পরে স্থানীয়রা দেখে কুকুরটিকে তাড়িয়ে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে।

সমাজবিজ্ঞানীরা যা বললেন:

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জিনাত হুদা ওয়াহিদ আরটিভি নিউজকে বলেন, সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে এসব ঘটনায় অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। আবার কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েও সামাজিক নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন কেউ কেউ। কিন্তু এসব পরিস্থিতির জন্য তো শিশুটি দায়ী নয়। সে তো সৃষ্টিকর্তার দান। তাকে হত্যা করা যাবে না। সামাজিক কুসংস্কার দূর করতে হবে।

প্রয়োজন ডিএনএ ব্যাংক:

রাজধানীর স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (মিটফোর্ড) ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. মাকসুদুর রহমান আরটিভি নিউজকে বলেন, অভিভাবকহীন নবজাতকের মরদেহেরও ময়নাতদন্ত করতে হয়। পুলিশ যেসব মরদেহ আমাদের ফরেনসিক বিভাগের মর্গে নিয়ে আসে ক্ষেত্রবিশেষ আমরা সেগুলোর ময়নাতদন্ত করে থাকি। তবে উদ্ধার হওয়া সব মরদেহের ময়নাতদন্ত হয় না। বেশির ভাগ রিপোর্টে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরই হত্যার আলামত উল্লেখ করা হয়। এ শিশুগুলো সাধারণত প্রিম্যাচিউরড হয়। শরীরের টিস্যু বা হাড় সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরি করে আমরা সিআইডিতে পাঠাই।

তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের দেশে উদ্ধার করা নবজাতকদের মরদেহের সঙ্গে ডিএনএ প্রোফাইল ম্যাচিং করা অসম্ভব। কারণ আমাদের ডিএনএ ব্যাংক নেই। এটি থাকলে অনেক অপরাধ কমে যেত। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংক থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে।’

সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার (এসএসপি) রুমানা আক্তার বলেন, ‘উদ্ধার করা নবজাতকদের ডিএনএ পাওয়া গেলেও তাদের মা-বাবার ডিএনএ স্যাম্পল পাওয়া যায় না। তাই পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে মা-বাবার পরিচয়ে সন্দেহ থাকলে তাদের নিয়ে পরিচয় যাচাই করা যায়।

পরিবারের ভূমিকা:

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ দেশের পরিবারগুলো রক্ষণশীল হওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত বা অবৈধ সম্পর্কের মাধ্যমে গর্ভধারণ করা শিশুর বিষয়ে তারা খুবই সংবেদনশীল। কোনো কারণে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলে তারা সম্মান বাঁচানোর হাতিয়ার হিসেবেই গর্ভপাতকেই বেছে নেয়। এমন গর্ভ ধারণকে তারা কখনই গ্রহণ করেন না। তাই এই বিষয়ে রাষ্ট্রকেই মুখ্য ভূমিকা পালন করতে হবে।