প্রচ্ছদ অর্থনীতি ১০ বছরে শিল্প-কারখানার অগ্নিকাণ্ডে ৭০০ শ্রমিকের মৃত্যু

১০ বছরে শিল্প-কারখানার অগ্নিকাণ্ডে ৭০০ শ্রমিকের মৃত্যু

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

সম্প্রতি নারায়ণগঞ্জের একটি কারখানায় আগুনে বহু হতাহতের পর পোশাক খাতের বাইরে শিল্প কারখানায় শ্রমিকদের নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিয়ে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

বর্তমানে রপ্তানিমুখী পোশাক কারখানাগুলোর নিরাপত্তা কিছুটা বাড়লেও অন্যান্য শিল্প কারখানায় মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শ্রমিকদের কাজ করতে হয় বলেই অভিযোগ উঠেছে। একই সাথে এসব কারখানা নিয়মনীতি মানছে কিনা – সেটি নজরদারি কতটা হচ্ছে, সে প্রশ্নও উঠেছে।

গত সপ্তাহে হাসেম ফুডস লিমিটেডের একটি কারখানায় আগুন লেগে অন্তত ৫২ জন শ্রমিক মারা গিয়েছিল। এরপর পোশাক খাতের বাইর শিল্প কারখানা নজরদারির ক্ষেত্রে অবহেলার অভিযোগ করে শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের অভিযোগ ভবনটিতে কদিন আগেও আগুন লেগেছিল। তারপরও সতর্কতামূলক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।

অগ্নি দুর্ঘটনায় জীবন রক্ষার প্রস্তুতি হিসেবে শ্রমিকদের জন্য কোনো মহড়া হতো না, ছিল না ফায়ার এলার্ম বা বিকল্প সিঁড়ি।

আর একসাথে এতবেশি শ্রমিকের মৃত্যুর কারণ হিসেবে অভিযোগ উঠেছে যে আগুন লাগার পরও ওই শ্রমিকদের বের হতে দেয়া হয়নি। যদিও কারখানার মালিকপক্ষ আটকে রাখার কথা অস্বীকার করছে। কিছুদিন আগেও আগুন লাগলে নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা না নেয়ার অভিযোগ।

হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার একাধিক নারী শ্রমিক অভিযোগ করেছেন যে তাদের কাজের পরিবেশ নিরাপদ ছিল না। কিছুদিন আগেও ওই কারখানায় আগুন লেগেছিল। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদারে কোনো কাজ হয়নি।

নারায়ণগঞ্জ জেলার রূপগঞ্জে অবস্থিত ওই কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে সময় লেগেছিল ৩৮ ঘণ্টারও বেশি। ছয় তলা কারখানাটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়লে ফায়ার সার্ভিসের ১৭টির মতো ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে কাজ করে।

অগ্নিকাণ্ডের পর ঘটনা তদন্তে একাধিক কমিটি হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও ঘটনার তদন্তে একাধিক কমিটি গঠিত হয়েছে।

ওই তদন্ত কমিটির অন্যতম সদস্য এবং কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন ফায়ার সার্ভিসের নারায়নগঞ্জ-২ এর উপ সহকারি পরিচালক তানহারুল ইসলাম।

তিনি বলেন, কারখানার ভবনটি অগ্নি দুর্ঘটনার জন্য সবদিক থেকেই ঝুকিপূর্ণ ছিল।

” এতবড় বিল্ডিং সেখানে মিনিমাম [কমপক্ষে] ছয় থেকে আটটা সিঁড়ি থাকার দরকার। সেখানে মাত্র দুইটা সিঁড়ি। এবং সিঁড়িগুলোর অবস্থান ভবন নির্মাণের বিধিমালা অনুযায়ী ত্রুটিপূর্ণ।”

মি. ইসলাম জানান, “এতবড় একটা ভবন এখানে ফায়ার এলার্ম থাকার কথা, স্মোক ডিটেক্টর থাকার কথা, হোজরিল থাকার কথা, ফায়ার এক্সিট থাকার কথা এর একটাও এখানে ছিল না।”

১০ বছরে শিল্প-কারখানায় আগুনে পুড়ে ৬৯৭ জন শ্রমিক মারা গিয়েছে – গবেষণা
মৃত্যুর হিসেবে গত এক দশকে তাজরীন ফ্যাশনসের পর বাংলাদেশে সবচেয়ে বড় শিল্প কারখানার অগ্নি দুর্ঘটনা হল হাসেম ফুডস লিমিটেডের কারখানার আগুন।

২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনসের আগুন এবং পরের বছর রানা প্লাজা ধ্বসের পর পোশাক খাতের কারখানাগুলো নিরাপত্তা বাড়াতে নানা উদ্যোগ দেখা গেছে। এক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী কারখানাগুলোর মালিকদের সঙ্গে অ্যাকর্ড অ্যালায়েন্স এবং কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর একত্রে কাজ করেছে।

২০১৮ সালের পর থেকে পোশাক কারখানায় অগ্নিকাণ্ড এবং মৃত্যু অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু একই সময়ে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের বেশিরভাগ ঘটনাই পোশাক খাতের বাইরে শিল্প কারখানায়।

বেসরকারি সংস্থা সেইফটি অ্যান্ড রাইটস’র হিসেবে গত দশ বছরে পোশাক খাতের বাইরে শিল্প কারখানায় ৪৫৩টি অগ্নিকাণ্ড এবং দুর্ঘটনায় অন্তত ৬শ ৯৭ জন শ্রমিক মারা গেছে।

নজরদারি না করায় বাড়ছে ঝুঁকি?
নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে গড়ে ওঠা শিল্প-কারখানা গুলোর বেশিরভাগই নজরদারির বাইরে রয়েছে বলেই অভিযোগ উঠেছে।

এ বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের যুগ্ম মহাপরিদর্শক ফরিদ আহমেদ বলেন, পরিদর্শন একেবারেই হয় না তা নয়। তবে তাদের সীমাবদ্ধতার কথাও তুলে ধরেন তিনি।

“আমাদেরকে ওয়ার্কারদের কিছু ব্যক্তিগত অভিযোগ অ্যাটেইন করতে হয়। জবলেস, বেতন সংক্রান্ত এরকম।”

আহমেদ জানান, “আমাদের জনবল প্রসঙ্গে বলি, আমাদের ছিল ৩৩৩ জন, এরপরে ৯শ ৩৩ জন হয়েছে। কিন্তু কিন্তু আমাদের রাইজের সাথে তুলনা করলে আমাদের শিল্পখাতের উন্নয়ন বা কমার্শিয়াল এন্টারপ্রাইজের ডেভলপমেন্টটা আরো দ্রুত হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ে ২ হাজার ৭শ ৮০ জন জনবল চেয়ে জন্য মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠিয়েছি। এছাড়া আমরা ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেইফটি ইউনিট গঠনের প্রস্তাব রেখেছি।”

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী,বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক খাতের বাইরে শিল্পকারখানার সংখ্যা ৫৬ হাজার ৯শ ৮৭টি।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর পোশাক কারখানার পরিবেশ আর ভবনের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ হলেও শিল্প কারখানার নিরাপত্তা নিয়ে খুব একটা কাজ হয়নি বলেই অভিযোগ শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন এবং অধিকারকর্মীদের।

বাংলাদেশ গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি কল্পনা আক্তার বলেন, এই দুর্ঘটনা দেখিয়ে দিল কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করছে।

“যারা এটাকে তদারকি করার দায়িত্বে ছিল, সেই তদারকি সংস্থা ডাইফি (কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর) তারা সেই পুরোনো গৎবাধা এক্সকিউজ দেখায়। জনবল বা প্রশিক্ষণ নাই এসব বলে।”

মিজ. আক্তারের অভিযোগ, “এই দুর্ঘটনার দায় অবশ্যই তাদের, এ দায় সরকারের, এ দায় অবশ্যই মালিকের।”

কল্পনা আক্তার বলেন, “আমি বলবো এটা অবশ্যই একটা প্রিভেন্টেবল অ্যাক্সিডেন্ট ছিল যদি আগে থেকেই আইনের প্রয়োগ থাকতো।”

“যদিও আইনে দুর্বলতা আছে তাতে কোনো সন্দেহ নাই। কিন্তু এটার প্রয়োগের যে জায়গাটা সেই প্রয়োগ এবং এটাকে নিয়ন্ত্রণ বা মনিটিরিং সেটাতো নাই।”

তার মতে, “তদারকি এত দুর্বল, এই দুর্বলতার কারণেই আমরা এতগুলো মানুষ হারিয়েছি। এমন একটা ঘটনা যেটা আমাদেরকে দেখাইছে যে কতটা ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশে কাজ করছে শ্রমিকরা।”

তিনি বলছেন, “আমাদের অদেখা কত কারখানায় শ্রমিকরা এভাবে নিষ্পেষিত হচ্ছে, প্রতিনিয়ত এরকম অনিরাপদ জায়গায় কাজ করছে – সেটাতো আমাদের জানাও নাই।”

বাংলাদেশে শিল্প কারখানা স্থাপনে নিয়ম-কানুন আর বিধি-বিধান থাকলেও কোনো বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই দেখা যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কারাখানা মালিকপক্ষ সেটি অমান্য করেছে বলে অভিযোগ। আর সেই সাথে সামনে আসে কর্তৃপক্ষের নজরদারির অবহেলার বিষয়টিও। সূত্র: বিবিসি বাংলা।