প্রচ্ছদ সারাদেশ খুলনা বিভাগ সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথের ১৮৫তম জন্মবার্ষিকী

সাংবাদিকতার প্রবাদ পুরুষ কাঙাল হরিনাথের ১৮৫তম জন্মবার্ষিকী

সুজন কুমার কর্মকার, কুষ্টিয়া : ৫ শ্রাবণ (২০ জুলাই)। সাংবাদিকতার পথিকৃত কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের ১৮৫তম জন্মবার্ষিকী। অগ্রণী সাংবাদিক হিসেবে কাঙাল হরিনাথ মজুমদারের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সাংবাদিকতার প্রথম প্রবাদ পুরুষ কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার উনিশশতকের এক স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি ছিলেন সাহিত্যিসাধক, সাময়িকপত্র-পরিচালক, সমাজ সংস্কারক এবং ধর্মবত্তা। ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা’ পত্রিকা পরিচালনার মাধ্যমে তিনি তৎকালীন সময়ে জমিদার-মহাজন-নীলকরের অত্যাচার-অবিচার ও শোষণের বিরুদ্ধে যে সাহসী ও বলিষ্ঠ ভুমিকা পালন করেছেন তা একটি বিষ্মকর ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। সম্পুন্ন আধুনিক পরিবেশের বাইরে নিভৃত পল¬¬ীতে বসে সংস্কৃতি চর্চ্চার যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছিলেন তা যথার্থই বিষ্মকর ও তুলনাহীন। এই মহান পুরুষটি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কুন্ডু পাড়ায় তিলি মজুমদার-বংশের এক দরিদ্র-শাখায় (বাংলা ১২৪০ সালের ৫ শ্র্রাবন) ইংরেজী ১৮৩৩ সালে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতার নাম হলধর সেন ও মাতা হরিনাথ কমলিনী দেবী। অত্যন্ত দারিদ্রতার মধ্যে তাকে বেঁচে থাকতে হয়েছে। এক টুকরো বস্ত্রের জন্য কাঙ্গালকে রাজা রামমোহন রায়ের চুর্ণক’ গ্রন্থটি এক রাতে নকল করে দিয়েছিলেন একজন ধনীব্যক্তিকে। অভিভাবকত্বের অভাব আর দারিদ্রতার কারণেই পরের স্নেহ ও পরের ঘরে খেয়ে, পরে মানুষ হতে হয়েছে বলে উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারেননি। কিন্তু নিজে শিক্ষায় শিক্ষিত হতে না পারলেও তাঁর লোক শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ও অনুরাগ ছিল। গ্রামের শিশু-কিশোরদের শিক্ষার জন্য তিনি ১৮৫৪ সালে কুমারখালীতে একটি বাঙ্গলা পাঠশালা স্থাপন করেন এবং ওই বিদ্যালয়ে তিনি বিনা বেতনে শিক্ষকতার দায়িত্ব গ্রহন করেন। ১৮৬০ সালে তাঁর বাড়ির চন্ডীমন্ডপে একটি বালিকা বিদ্যালয়ও স্থাপন করেন। হরিনাথের স্মরণীয় গ্রন্থ বিজয়বসন্ত (১৮৫৯) একটি উলে¬খযোগ্য গ্রন্থ। এ ছাড়া পদ্যপুন্ডরীক, দ্বাদশ শিশুর বিবরণ, চারুচরিত্র, কবিতাকৌমুদি, বিজয়া, কবি কল্প, অক্রুরসংবাদ, সাবিত্রি নাটিকা, চিত্তচপলা, একলভ্যের অধ্যাবসায়, কাঙ্গাল-ফকিরচাঁদ ফকীরের গীতাবলী, কৃষ্ণকালী-লীলা, মাতৃ-মহিমা, আত্মচরিত ও হরিনাথ গ্রন্থাবলীসহ অসংখ্য গ্রন্থ রয়েছে। কাঙ্গাল হরিনাথ নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান। একটি মফস্বল এলাকায় থেকে এত বড় জাগ্রত চিত্তের মানুষ আর দ্বিতীয় জন ছিলনা সে সময়। জমিদার, মহাজন, কুঠিয়াল ও গোরা পল্টনের অত্যাচার ও উৎপীড়ন প্রত্যক্ষ করে তাঁর মনে যে বিদ্রোহ সৃষ্টি হয়েছিল এবং তাতেই তিনি গ্রামবার্ত্তা প্রকাশের প্রেরণা লাভ করেন। গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারতেœর যন্ত্রে মুদ্রিত ও কুমারখালী থেকে প্রকাশিত হতো। চার ফর্মার এই মাসিক পত্রিকাটির মুল্য ছিল পাঁচ আনা। গ্রাম-হিতৈষণার আদর্শ নিয়েই গ্রামবার্ত্তা’র মুলত আত্মপ্রকাশ হয়। মাসিক, পাক্ষিক ও সাপ্তাহিক হিসেবে কয়েক পর্যায়ে মোট ২২ বছর চলেছিল পত্রিকাটি। গ্রামবার্ত্তা প্রথমে কলকাতার গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্বের বিদ্যারতœ যন্ত্রে মুদ্রিত হতো। পরে রাজীবলোচন মজুমদারের সহায়তায় ১২৮০ সালের প্রথমদিকে কুমারখালীতে ‘মথুরানাথ যন্ত্র’ বা এম এন প্রেস থেকে গ্রামবার্ত্তা মুদ্রিত হতো। প্রেস স্থাপনের পর হরিনাথ কয়েক বছর গ্রামবার্ত্তা পরিচালনা করে ঋণগ্রস্ত হন, তখন কুমারখালী বাংলা পাঠশালার প্রধান শিক্ষক প্রসন্নকুমার বন্দোপাধ্যায় ও আরো কয়েকজন শুভাকাংখি গ্রামবার্ত্তা’র পরিচালনাভার গ্রহন করেন। তাঁরা কয়েকবছর পত্রিকা প্রকাশ করেন, কিন্তু ক্রমে ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় হরিনাথ পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দেন। পরে ১২৮৯ সালের বৈশাখ মাসে তাঁর শিষ্য জলধর সেন, অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়, শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণবের উদ্যোগে গ্রামবার্ত্তা পুনরপ্রকাশিত হয় এবং ১২৯২ সালের আশ্বিন মাস পর্যন্ত তা চালু থাকে। প্রয়োজনীয় সহযোগীতা ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করলে গ্রামবার্ত্তা আরো দীর্ঘকাল পরিচালিত হয়ে জনগণের সেবা করতে পারতো। কিন্তু গ্রাহকদের ‘নেব দেবনা প্রবৃত্তি’ ও পৃষ্ঠপোষকদের প্রতিশ্র“ত সহযোগীতার অভাবেই মুলত এর প্রকাশনা বিঘিœত ও অবশেষে বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামবার্ত্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার ক্রমান্বয়ে নানা সমস্যার মধ্যে পতিত হন। ৫ বৈশাখ ১৩০৩ বঙ্গাব্দে তিনি পরলোক গমন করেন।