প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ সংলাপ: কেমন ছিল গণভবনের ভেতরের পরিবেশ?

সংলাপ: কেমন ছিল গণভবনের ভেতরের পরিবেশ?

গত কয়েকদিন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে সংলাপে বসতে চেয়ে এবং সংলাপের আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি চালাচালি দেখেছে দেশবাসী। একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে সংলাপের এমন হাঁক-ডাকে দেশবাসীর চোখ ছিল গণভবনের দিকে। কিন্তু যাদেরকে ঘিরে সংলাপ তারা কতটা প্রস্তুত ছিলেন? আর গণভবনে সংলাপের ভেতরের পরিবেশ কেমন ছিল?

সংলাপে উপস্থিত থাকা একাধিক নেতা বলছেন, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট কিংবা ১৪দল সকলের মধ্যে প্রস্তুতির অভাব থাকলেও টোটাল হোম ওয়ার্ক করেই সংলাপের টেবিলে বসেছিলেন শেখ হাসিনা। অন্যদিকে শেখ হাসিনার অনেক প্রশ্নেই নিরুত্তর ছিলে ড. কামালসহ ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার ওই সংলাপের শুরুতেই বক্তব্য রাখেন প্রধান প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তিনি তার বক্তব্যে সরকারের গত প্রায় ১০ বছরের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের উদাহরণ তুলে ধরে তা মূল্যায়ন করার ভার ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের উপর ছেড়ে দেন। সরকারের এই সময়ে দেশের মানুষ ভালো আছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। সেই সঙ্গে একাদশ জাতীয় নির্বাচন কমিশনের অধীনে যাতে সুষ্ঠু শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা নির্বাচন কমিশনকে করা হবে বলে ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের আশ্বস্ত করেন।

এরপরই বক্তব্য রাখেন ঐক্যফ্রন্ট আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। তিনি সাত দফার ভিত্তিতে বক্তব্য শুরু করেন। তার বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন: সংবিধানকে সমুন্নত রেখেই আমাদের সকল সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কোন অনির্বাচিত ব্যক্তি যেন রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে না পারে সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। আপনি ৭২’র সংবিধান প্রণয়নে অন্যতম ভূমিকা পালন করেছেন। আমরা সেই ৭২’র সংবিধানেই ফিরতে চাচ্ছি, এখানে আপনার (ড. কামাল) কি আপত্তি আছে?

‘প্রধানমন্ত্রীর এমন প্রশ্নের জবাবে চুপ ছিলেন ড. কামাল’, এমনটাই বলছেন আওয়ামী লীগ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান।

খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন: তার (খালেদা জিয়া) বিরুদ্ধে মামলা আমরা করিনি। মামলা করেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

এসময় তিনি বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে ইঙ্গিত করে বলেন: আপনারা সবাই জানেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যারা ছিল তাদের অধিকাংশই বিএনপির লোক। সাজা দিয়েছেন আদালত। সরকারের কিছু নেই। খালেদা জিয়ার মুক্তি চাইলে আইনি লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। সরকারের কিছু করার নেই।

ড. কামাল হোসেন তার বক্তব্যে নির্বাচনকালীন সময়ে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দেওয়ার দাবি তোলেন। তার জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন এ পর্যন্ত যে কয়েকটি নির্বাচন আমরা দেখেছি তার মধ্যে শুধুমাত্র ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনীর ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার ছিল। সেই নির্বাচন কেমন ছিল তা আপনারা সবাই জানেন। আপনি কি ২০০১ সালকে উদাহরণ মানতে চান?

‘এই প্রশ্নের জবাবেও ড. কামাল চুপ ছিলেন’ বলে জানান আওয়ামী লীগের আরেক যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।

এমন অনেক প্রশ্নের জবাবেই নিশ্চুপ থাকেন কামাল ও ঐক্যফ্রন্ট নেতারা।

ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য শুরুর পর একে একে বক্তব্য রাখেন ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। এরপর ঐক্যফ্রন্ট নেতাদের বক্তব্য ধরে ধরে জবাব দেন আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের নেতারা। এক্ষেত্রে অনেকটাই সরব প্রতিক্রিয়া দেখান ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন এবং জাসদ একাংশের সভাপতি হাসানুল হক ইনু।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের দাবি তুললে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন: আপনারা সমাবেশ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে কোনো বাধা থাকবে না। আমাদের কোন সহযোগিতার দরকার হলে আমরা তা করব। প্রয়োজনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একটা কর্নার করে দেব। যেখানে আপনারা ইচ্ছামতো সমাবেশ করতে পারবেন। তবে রাস্তা দখল করে সমাবেশ করা যাবে না।

এসময় ফখরুল অভিযোগ করেন বিএনপি নেতাকর্মীদের মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দমিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। জবাবে, কোথায় কোথায় মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে তার একটি তালিকা তাকে (প্রধানমন্ত্রী) দেওয়ার জন্য বলেন। তালিকা পেলে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন প্রধানমন্ত্রী।

বিএনপি নেতা এবং ড. কামাল হোসেনের ৭ দফা উত্থাপনের বাইরে ঐক্য জোটের কোনো নেতাই খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি সংলাপে উপস্থাপন করেননি।

এক পর্যায়ে ঐক্য জোটের নেতাদের পক্ষ থেকে নির্বাচনের সময় ডিসেম্বর থেকে আরও পিছিয়ে নেওয়ার দাবি জানানো হয়। বলা হয় রাজনৈতিক বোঝাপড়ার পরিবেশের জন্য আরো সংলাপের প্রয়োজন রয়েছে। তাতে করে ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্ভব না। জবাবে প্রধানমন্ত্রী ঐক্যজোট নেতাদের বলেন, ৮ তারিখ (নভেম্বর) পর্যন্ত সময় রয়েছে।আপনার চাইলে আমরা বসতে পারি। কিন্তু নির্বাচনী পেছানোর কোন সুযোগ নেই। সংবিধানের বাইরে যাওয়া সম্ভব না।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট নেতারা প্রশ্ন তুললে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দেন সংবিধানের বাইরে কিছু করার সুযোগ নেই।

রাজনৈতিক বোঝাপড়ার পরিবেশের কথা উঠতেই প্রধানমন্ত্রী ২০১৪’র নির্বাচনের আগে পরিবেশ উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন। তখনকার বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে সংলাপের জন্য বারবার আহ্বান জানানোর পরও তিনি কীভাবে প্রত্যাক্ষিত হয়েছিলেন সে উদাহরণ ঐক্যজোট নেতাদের সামনে তুলে ধরেন।

এমনকি নির্বাচনের পরের বছর বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে বেগম জিয়াকে সান্ত্বনা জানাতে জানাতে গিয়ে অপমানিত হয়ে ফিরে আসার কথাও সংলাপে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। শুরুতে বক্তব্য দেওয়ার পর থেকে অধিকাংশ সময়ই নিশ্চুপ ছিলেন ড. কামাল হোসেন। সবশেষে তিনি বলেন: আমার অনেক কিছুই জানা ছিল না। আপনার (প্রধানমন্ত্রী) কথায় জানতে পারলাম।

একই সঙ্গে আলোচনায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন ঐক্যফ্রন্ট অহ্বায়ক।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছাড়া তার জোট এবং ঐক্যফ্রন্ট কারোই সংলাপের জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি ছিলো না এটা বলা চলে।

গত রোববার একফ্রন্টের আহ্বায়ক ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন দেশের রাজনৈতিক সংকট নিরসন এবং একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংলাপের বসার জন্য সময় চেয়ে গণভবনের ঠিকানায় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা বরাবর চিঠি লেখেন৷

পরদিন সোমবার আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ধানমন্ডিস্থ দলের সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে জানান ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ। পরদিন মঙ্গলবার সংলাপের সময় জানিয়ে আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী আবদুস সোবহান গোলাপ ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় প্রধানমন্ত্রীর চিঠি নিয়ে যান। ওই দিনই সন্ধ্যায় ড. কামাল হোসেনসহ ১৫ ঐক্যফ্রন্ট নেতার নাম তালিকা ধানমন্ডিস্থ আওয়ামী লীগ পার্টি অফিসে। একদিন বাদে বুধবার বিকালে ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসতে যাওয়া প্রতিনিধি দলের নাম প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ। যাতে শেখ হাসিনা নেতৃত্বে ২০ নেতা সংলাপে অংশ নেবেন বলে জানানো হয়।

প্রস্তুতির অভাবটা চোখে পড়তে শুরু করে এখান থেকে। মঙ্গলবার সকালে সচিবালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপ টা হবে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের। কিন্তু তালিকায় দেখা যায় আওয়ামী লীগের সঙ্গে সঙ্গে তাদের নির্বাচনী রাজনৈতিক জোট ১৪ দলের নেতাদের কেউ রাখা হয়েছে।

শুধু তাই নয় এরপর আরো দুই সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক এবং সিনিয়র নেতা অ্যাডভোকেট আব্দুল মতিন খসরুর নাম। যাতে ক্ষমতাসীনদের সংলাপে প্রস্তুতির অভাবটা অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

এখানেই শেষ নয় সংলাপের ঠিক আগ মুহূর্তে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় আরো ৫ নাম। যাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় চৌধুরীর নাম অন্তর্ভুক্ত হলেও শেষ মুহূর্তে তিনি সংলাপে অংশ নেননি। যা ঐক্যফ্রন্টের প্রস্তুতি নিয়ে সংলাপ প্রস্তুতি ও তাদের বোঝাপোড়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে প্রশ্নের সৃষ্টি করে।