প্রচ্ছদ হেড লাইন প্রবাসী শ্রমিকদের আকুতি : দেশে হাত পাততে পারতেছি না, বলতেও পারতেছি না

প্রবাসী শ্রমিকদের আকুতি : দেশে হাত পাততে পারতেছি না, বলতেও পারতেছি না

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

করোনাভাইরাস মহামারীতে বিশ্বজুড়ে লকডাউন এবং অচলাবস্থার কারণে বহুমাত্রিক সংকট দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের জনশক্তি রপ্তানি খাতে। প্রবাসে বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাংলাদেশীরা একদিকে বেতন পাচ্ছেন না আবার অনেকে ছাটাই এবং মজুরি হ্রাসের কবলে পড়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে গত মার্চ মাসে প্রবাসীরা ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছে যা চলতি অর্থবছরই শুধু নয় বিগত ১৫ মাসের মধ্যেও সর্বনিম্ন। চলতি বছরের নয় মাসে গড় রেমিটেন্স ছিল মাসে ১৫৩ কোটি ডলার। বিশ্বজুড়ে করোনা মহামারীর প্রভাবে প্রবাসীদের টাকা পাঠানোর পরিমাণ আরো কমতে পারে বলেও আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

পৃথিবীর ১৬৯টি দেশে বাংলাদেশের এক কোটিরও বেশি মানুষ কাজ করেন। এর মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশেরই কর্মসংস্থান মধ্যপ্রাচ্যে। বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের অনেকেই এখন বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারছেন না। চাকরি নিয়েও আছে দুশ্চিন্তা।

মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে কর্মরত তোফাজ্জল হোসেন জানান তিন মাস ধরে তিনি দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। গত মাসে বেতনভাতাও পাননি। তিনি যে কারখানায় কাজ করেন সেটিও বন্ধ।

‘বাড়ী থেকে যোগাযোগ করতেছে যে টাকা পয়সা দরকার। সামনে রমজান তারপরে জিনিসপত্রের দাম বাইড়া যাইতেছে কিছু কেনাকাটা দরকার।’

তিনি বলেন, ‘কোনোটাইতো হইতেছে না। এখানে আমরা আছি বহুত করুণ অবস্থায়। আর আমরা প্রাইভেট সেক্টরে কাজ করি ভাই। কোনো নিশ্চয়তা নাই।’

‘সমস্যাতো এখানেই দাঁড়াইছে দেশে আমরা কারো কাছে হাত পাততে পারতেছি না, কারো কাছে বলতেও পারতেছি না।’

মধ্যপ্রাচ্যে দেশ সৌদি আরবে কাজ করেন সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশী। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সৌদি আরবে যে কড়াকড়ি চলছে তাতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই।

এছাড়া মহামারির প্রভাবে দেশটির তেলনির্ভর অর্থনীতিও মন্দার কবলে। এ অবস্থায় সৌদিতে বহু প্রতিষ্ঠানে বেতন কাটা হচ্ছে এবং শ্রমিক ছাঁটাই শুরু হয়েছে বলে জানান সৌদি আরব প্রবাসী এস. এম. শামীম।

‘আমার নিজের কোম্পানি প্রচুর সংখ্যক শ্রমিক ছাঁটাই করতেছে। ছাঁটাই একটা বিরাট সমস্যা হয়ে গেছে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে বেতন কাটতেছে।’

তিনি জানান, ‘ধরেন যাদের বেতন ২-৪ হাজার ছিল তাদের বেতন দুই হাজারে নিয়ে আসতেছে। ৪ হাজারের উপরে যাদের বেতন তাদের বেতন পঞ্চাশ ভাগ কাটতেছে।’

সংকটে প্রবাসীদের পরিবার
এদিকে এ পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশে থাকা প্রবাসীদের পরিবারগুলোতে আর্থিক সংকট দেখা দিচ্ছে। কথা বলে বোঝা যাচ্ছে অনেকেই সংকটে পড়ে গেছেন। বরিশালের আমেনা বেগম জানান তার স্বামী সৌদি আরবে থাকেন বড় ছেলে মালয়েশিয়ায়। দুমাসের বেশি টাকা আসেনি, সামনে সংসার চালানো নিয়েই তার এখন অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

‘যা ছিল হাতে দুই-তিন মাস আগে পাঠানো টাকা তা শেষের দিকে। আমরাতো একবারেই বাজার করি। এখন বাজার শেষপ্রান্তে।’

বিবিসিকে তিনি জানান, ‘আমি আর দশ-বারোদিন সর্বোচ্চ ১৫দিন চলতে পারবো। আর কবে তাদের লকডাউন ছাড়বে এটাও বলতে পারছেন না।’

বিদেশ যাওয়া বন্ধ, আয় কমে যাওয়ার পাশাপাশি দেশে এসে কর্মস্থলে ফেরা নিয়েও অনিশ্চয়তায় প্রায় দুই লাখ প্রবাসী।
কাজে ফেরা নিয়ে অনিশ্চয়তা চট্টগ্রামের এক পরিবারের তিনভাই মাসচারেক আগে দেশে এসেছিলেন। কবে আবার কাজে ফিরতে পারবেন সেটি নিয়েই তারা উদ্বিগ্ন।

কাতার প্রবাসী ইমরান হোসেন শিবলু বলেন, উপার্জনকারী তিন ভাই প্রত্যেকে এখন দেশে একজন বিদেশে থাকলেও হয়তো সাপোর্ট পাওয়া যেতো। ‘দুশ্চিন্তা কাজ করতেছে। সেটা হচ্ছে আমাদের ১৮০ দিনের মধ্যে যে যেখানে থাকি না কেন আবার এন্ট্রি হওয়ার যে নিয়ম রয়েছে সেটার কী হবে। আবার ভিসা সংক্রান্ত কোনো জটিলতা হয় কিনা!’

সবমিলিয়ে করোনাভাইরাস মহামারি বিশ্বজুড়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে তার বহুমুখী প্রভাব দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী আয়ে।

প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে ‘তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ’ হচ্ছে বাংলাদেশ
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচীর প্রধান শরিফুল হাসান বলেন নতুন কর্মসংস্থান বন্ধ, পুরোনোদের চাকরির অনিশ্চয়তা এবং দেশে ফেরা প্রবাসীদের নিয়ে বাংলাদেশ তিনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

‘আমরা জানিনা আমাদের কী পরিমাণ লোক কাজ হারবে। ইতোমধ্যে তিন মাসের ক্ষতি যদি বলি-তিনমাসে দেড় লাখ লোক কর্মসংস্থান বঞ্চিত, প্রায় দুই লাখ লোক ফেরত এসেছে এবং বিদেশে থাকা এক কোটি লোকের মধ্যে অন্ততপক্ষে ৫০ লাখ লোকের এই মুহূর্তে কোনো কাজ নেই।’

‘এই করোনার মধ্যেও কিন্তু সৌদি আরব থেকে আমাদের ৩৬৬জন ফেরত এসেছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান অনেকেই কিন্তু তালিকা দিয়ে বলছে যে কিছু বাংলাদেশিকে ফেরত আনতে হবে।’

এ সংকট কবে কাটবে সেটিও অনিশ্চিত উল্লেখ করে হাসান বলেন, ‘এই প্রবাসীদের পাশে কীভাবে থাকা যায় সেটা আমাদের নিশ্চিত করতেই হবে।’

‘কারণ আমাদের জিডিপিতে অন্তত ১০ শতাংশ অবদান প্রবাসী আয়ের। কাজেই আমাদের প্রবাসী আয় যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় যেটা ইতোমধ্যে হতে শুরু হয়েছে, আমরা জানিনা সেটা আমরা কী করে শামাল দেব!’

তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি সে পরিকল্পনাগুলো আমাদের এখনই করে রাখা দরকার। তবে এই মুহূর্তে প্রবাসীদের লড়াইটা হচ্ছে টিকে থাকার লড়াই, বেঁচে থাকার লড়াই।’

‘দুশো কোটি টাকার তহবিল গঠন’
এদিকে বিষয়টি নিয়ে সরকারও চিন্তিত। মধ্যপ্রাচ্য এবং মালয়শিয়া থেকে প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার এবং সবমিলিয়ে ২৪ হাজারের মতো অবৈধ বাংলাদেশি ফিরিয়ে আনার একটা চাপ তৈরি হয়েছে।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা এ সংকট মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা করছি। ক্ষতিগ্রস্ত প্রবাসীদের জন্য দুশো কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হয়েছে।’

‘সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত তাদের ঋণ দেয়া হবে যাতে এখানে কিছু করতে পারেন। এছাড়া বিদেশে শ্রমিকদের দেখভালের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করে বিতরণ করা হয়েছে।’

তবে দেশে অবস্থানরত প্রবাসী কিংবা তাদের পরিবারের কাছে কবে নাগাদ আর্থিক সহায়তা দেয়ার কাজ শুরু হবে সেটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রী।

সূত্র : বিবিসি