প্রচ্ছদ খেলাধুলা নামছে আর্জেন্টিনার পতাকা, চলছে দল বদল

নামছে আর্জেন্টিনার পতাকা, চলছে দল বদল

বিশ্বকাপ ফুটবলে ১৯৮৬ সালের পর থেকে তেমন কোনো সাফল্য না পেলেও বাংলাদেশিদের কাছে জনপ্রিয়তায় অন্যতম শীর্ষে থাকা আর্জেন্টিনার ‘নাজুক’ হার!  এরপর থেকেই ফুটবলের সবচেয়ে বড় এই আসর উপলক্ষে টাঙানো পতাকা নামতে শুরু করেছে। বৃহস্পতিবার (২১ জুন) দিবাগত রাতে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ৩-০ গোলের হারের পর দলের সমর্থকরা নিজেদের অবস্থান পাল্টে অন্যান্য দল সমর্থন শুরু করেছেন। লজ্জার এই হারের পর  দলটির অনেক সমর্থকই নিজেদের  মোবাইল ফোন বন্ধ ও ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছেন বলে আলোচনা চলছে সোশ্যাল মিডিয়ায়।

শুধু বাংলাদেশ নয়, ফলাফল কিংবা র‌্যাংকিংয়ের দিক থেকে ব্রাজিলের কাছাকাছি না হলেও শুধু বাংলাদেশিরাই নয় বরং আর্জেন্টিনার নাগরিকরাও মনে করেন ব্রাজিলই তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ খেলা শুরুর পর থেকে ব্রাজিল যতবার কাপ নিয়েছে। ততবার সেমিফাইনাল অব্দি যেতে পারেনি দলটি। তবুও ব্রাজিলকেই যে দেশটি সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ মনে করে তা ফুটে উঠেছে তাদের নানা কর্মে। ২০০৯ সালে দেশটির এক ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের জন্য নির্মিত এক বিজ্ঞাপন চিত্রেও ফুটে ওঠে বিষয়টি।

বিজ্ঞাপনচিত্রে দেখানো হয়, সিনেমার শুটিং চলার সময় অভিনেতা ঠিকভাবে কান্নার এক্সপ্রেশন দিতে পারছেন না। কিছুতেই যখন তার অভিনয় হচ্ছিল না তখন পরিচালক বলেন, মনে করো আমরা ১৯৮৬ সালের পর থেকে কাপ জিততে পারিনি। তখন পরিচালক তার অভিনয়ে সন্তুষ্ট হন। অভিনয় চমৎকার হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। এরপর তিনি অভিনেতাকে বলেন, আমাদের থেকে ব্রাজিল তিনবার বেশি কাপ নিয়েছে। কিছুদিন আগে আমরা চিলির কাছে হেরেছি। এরপর আর নতুন করে ওই দৃশ্যের শুট করতে হয়নি।

মাঠ কিংবা সিনেমার পর্দা ছাপিয়ে ফুটবল নিয়ে এই দুই দেশ এবং দেশের সমর্থকদের উত্তাপ ছাড়িয়েছে বাংলাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও। গেল ১৭ জুন সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে ব্রাজিলের ম্যাচ ড্র হওয়ার পর খুলনার দৌলতপুরে ব্রাজিল সমর্থকদের তাচ্ছিল্য করার অভিযোগে দুই আর্জেন্টাইন সমর্থককে কুপিয়ে আহত করেন ব্রাজিল সমর্থকরা। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা তো ছিলই।

র‌্যাংকিংয়ের দিক থেকেও ব্রাজিলের থেকে তিন ধাপ পিছিয়ে থাকা আর্জেন্টাইন সমর্থকরা নানাভাবে বিশ্বের অন্যতম সেরা দলটির সমর্থকদের সঙ্গে পাল্লা দিতে শুরু করেন। বিশ্বকাপ শুরুর আগে থেকেই ব্রাজিল সমর্থকদের সঙ্গে পাল্লার অংশ হিসেবে তারা বড় পতাকা উড়ানো, বাড়ি রং করা থেকে শুরু করে নানা রকম বিদ্বেষমূলক আচরণ শুরু করেন।

নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার লালপুর এলাকার জয়নাল আবেদিন ওরফে টুটুল নামের এক ব্রাজিল ভক্ত নিজের ৬ তলা বাড়ির পুরোটাই ব্রাজিলের রঙে রাঙিয়ে বেশ আলোচনায় এসেছিলেন। এর কয়েকদিন পর নারায়ণগঞ্জের গলাচিপা এলাকায় আর্জেন্টিনার পতাকার বাড়ি রাঙিয়ে আলোচনায় আসেন মো. আউয়াল নামের এক ব্যক্তি। এমন রেষারেষি চলতে থাকে পতাকা উড়ানোতেও। রাজধানীর এক বাড়ির ছাদে ব্রাজিল সমর্থকরা ২ ফিট পতাকা উড়ালে আর্জেন্টাইন সমর্থকরা উড়ান চার ফিট পতাকা। প্রতিবার বিশ্বকাপ এলে বিদেশি পতাকা উড়ানোর বিষয়টিতে ক্ষুব্ধ হয়ে এক মুক্তিযোদ্ধা হাইকোর্টে রিটও করেন। তার রিটে বিদেশি পতাকা উড়ানো বন্ধের সিদ্ধান্ত না আসলেও আর্জেন্টিনার ‘ক্রমাগত বাজে পারফরমেন্সে’ দেশের বিভিন্ন এলাকায় শুক্রবার রাত থেকেই পতাকা নামতে শুরু করে।

বৃহস্পতিবার বিকেলেও যেসব স্থান আর্জেন্টিনার বড় বড় পতাকায় ছেয়ে ছিল সেগুলোর অনেকটাই শুক্রবার সকালেই নাই হয়ে যায়! মোহাম্মদপুরের টিক্কাপাড়া এলাকার ৬০ শতাংশেরও বেশি আর্জেন্টিনার পতাকা খুলে ফেলতে দেখা যায় শুক্রবার সকালে। রাজধানীসহ দেশের অন্যান্য এলাকাতেও একই ঘটনা ঘটেছে।

পতাকা খুলে ফেলা প্রসঙ্গে মোহাম্মদপুরের আহাদ নামের এক আর্জেন্টাইন সমর্থক বলেন, খুব উৎসাহ নিয়ে পতাকা টাঙিয়েছিলাম। এখনো দ্বিতীয় রাউন্ডে যাওয়া আশা ফুরিয়ে না গেলেও এই টিম নিয়ে যে বিশ্বকাপ জেতা সম্ভব নয়, তা পরিষ্কার। আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিলাম, আছি এবং থাকবো কিন্তু প্রতিবেশী ও বন্ধুদের ট্রলের শিকার হতে চাই না বলেই পতাকা নামিয়ে ফেলছি।

তবে, ট্রল কিংবা আর্জেন্টিনার বাজে পারফরমেন্সের বিষয়টি বারবার সামনে নিয়ে আসার মতো ঘটনা যে একেবারেই ঘটেনি তা বলা যাবে না। যেমন স্নেহাশিষ মজুমদার নামের এক ব্যক্তি খুব দুঃখ করেই বলছিলেন, আজ আর্জেন্টিনা না হারলে হয়তো বুঝতেই পারতাম না বাংলাদেশে ক্রোয়েশিয়ার এত সমর্থক আছে। আমরা হয়তো বিশ্বকাপ জয়ের আশা হারিয়েছি, কিন্তু যারা আমাদের তাচ্ছিল্য করছে বিকেলেই তাদের খেলা। দেখা যাবে মাঠে তারা কী পারফর্ম করেন।

এদিকে, প্রিয় দলের হারের পর দলটির সর্বশেষ বিশ্বকাপ জয়ের নায়কের সঙ্গে কেঁদেছেন সমর্থকরাও। অনেকে লজ্জায় ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। ফেসবুক অ্যাকাউন্টও ডিঅ্যাক্টিভেট করে রেখেছেন অনেকে। প্রত্যেকের পরিচিতর লিস্টেই এমন ব্যক্তি রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে।

কামাল হোসেন রণি নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘বন্ধুর সঙ্গে জরুরি কথা বলবো। কিন্তু খেলায় তার সমর্থিত দল হেরে যাওয়ায় ফেসবুক-মোবাইল ফোন সবই বন্ধ করে রেখেছে।

এদিকে নিজের সমর্থনের দলের এমন পারফরমেন্সের পর অনেকেই অভিমানে যেমন দল নিয়ে বাজে মন্তব্য করছেন তেমনি দলের সমর্থনও পাল্টাচ্ছেনও অনেকে।

মাহবুব আলম নামের এক ব্যক্তি বলেছেন, প্রতিবারই ভাবি, দল পরিবর্তন করব। কিন্তু কোনোবারই হয়ে ওঠে না। কিন্তু এবার আর না, আর আর্জেন্টিনা না। এখন থেকে বিশ্বের সেরা দল ব্রাজিলের সাপোর্টার আমি।

আগে আর্জেন্টিনার সমর্থন করতেন এমন বিষয়টি অনেকে এখন স্বীকারও করছেন না। বিশ্বকাপ শুরুর আগে খুবই উচ্ছ্বসিত ছিলেন সিফাত নামের এক আর্জেন্টাইন সমর্থক। তবে, শুক্রবার (২২ জুন) সকালে উঠেই তিনি বলেন, আমি কোনোদিনই আর্জেন্টিনার সমর্থক ছিলাম না। আমি সবসময় বেলজিয়ামের সাপোর্টার, এবারও বেলজিয়ামের সমর্থনই করছি।

বিশ্বকাপে বেশিরভাগ সময়েই আর্জেন্টিনা শুরুতেই বাদ পড়ে যাওয়ায় অনেক সমর্থকই দ্বিতীয় একটি দল পছন্দ করে রাখেন। এমন ঘটনার বিপরীত ঘটেনি এবারও। তৌহিদ হাসান অনি নামের এক আর্জেন্টাইন সমর্থক লেখেন, ‘সমস্যা নেই, আর্জেন্টিনা হেরে গেলেও জার্মানিতো এখনও বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েনি। আজ থেকে জার্মানিকে সমর্থন দিচ্ছি।’