প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক নওয়াজ শরিফকে ঠেকাতে সব ধরণের কৌশল খাটাচ্ছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী

নওয়াজ শরিফকে ঠেকাতে সব ধরণের কৌশল খাটাচ্ছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী

পাকিস্তানের সেনাবাহিনী আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় দেশটির সাধারণ নির্বাচন পাতানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে সেনা মুখপাত্র এই দাবি পুরোপুরি উড়িয়ে দিয়েছেন। অবশ্য এমনটা নজিরবিহীন নয়। ১৯৯০ সালে সেনা-কর্তৃত্বাধীন গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই দেশের বামঘেঁষা পিপল’স পার্টির (পিপিপি) প্রতিপক্ষ দলগুলোর মাঝে অর্থ বিলায়। আর পরাজিত হয় পিপিপি। তবে এবারও এ ধরণের তৎপরতা চালানোর যেই অভিযোগ আইএসআই’র বিরুদ্ধে তা কড়া ভাষায় অস্বীকার করেছেন সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র জেনারেল আসিফ গফুর।কিন্তু এই অভিযোগের স্বপক্ষে প্রমাণ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।

লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। ‘পাকিস্তান আর্মি ইজ ইউজিং এভরি ট্রিক টু সাইডলাইন নাওয়াজ শরিফ’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, এবার সেনা হস্তক্ষেপের লক্ষ্যবস্তু হলেন নওয়াজ শরিফ, যিনি গত বছর প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে অপসারিত হন। মজার ব্যাপার হলো, ১৯৯০ সালের নির্বাচনে সেনা হস্তক্ষেপের প্রধান লাভ্যাংশভোগী ছিলেন এই নওয়াজ। সেবার তিনি প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। কিন্তু শিগগিরই সেনাবাহিনীর সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয় তার।

১৯৯৩ সালেই সেনাবাহিনীর চাপের মুখে পদত্যাগ করেন নওয়াজ। এরপর ১৯৯৯ সালে তার বিরুদ্ধে সরাসরি অভ্যুত্থান করে সেনাবাহিনী। কিন্তু ২০১৩ সালে আবার ক্ষমতায় আসেন তিনি। এসেই দেশের পররাষ্ট্র ও নিরাপত্তা নীতিতে বেসামরিক সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উন্মুখ হয়ে পড়েন। আবার এই দুই ইস্যুকেই নিজের একচ্ছত্র কর্তৃত্বাধীন বলে মনে করে সেনাবাহিনী।

নওয়াজ যখন বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব স্থাপন করতে চাইলেন, সেনাবাহিনী তখন অনেকটা প্রকাশ্যেই তার প্রশাসনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো। এমনকি বিরোধী দল পাকিস্তান মুভমেন্ট ফর জাস্টিসের (পিটিআই)-এর কয়েক মাসব্যপী সরকার-বিরোধী বিক্ষোভে সমর্থনও দেয় সেনাবাহিনী। এছাড়া গতবছর রাজধানীর একটি ব্যস্ততম মোড় একদল প্রতিবাদকারী দখলে নিলে তাদেরকে হটাতে সেনাবাহিনীর সহায়তা চায় সরকার। তবে সেনাবাহিনী তখন সরকারের ওই অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে। বরং, এক সেনা জেনারেলকে দেখা গেছে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে অর্থ বিতরণ করতে। গত বছর কথিত ‘অসততা’র মতো হাস্যকর অভিযোগে যখন সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে অপসারণ করে, তার পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ছিল বলে অনেকের দাবি। তবে সেনাবাহিনী এমন অভিযোগ বেশ কড়া ভাষায় অস্বীকার করে। নওয়াজ শরিফ তাকে অপসারণের পেছনে অদৃশ্য হাতের ভূমিকা থাকার দাবি করেন।
এটি সত্য, নওয়াজ শরিফ চান তার প্রতি সেনারা যেই আচরণ করেছে, তার ফয়সালার ক্ষেত্র যেন হয়ে উঠে আগামী নির্বাচন। তবে তিনিও সরাসরি সেনাবাহিনী শব্দটি উচ্চারণ করেন না। সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাকে বোঝাতে তিনি ‘এসটাবলিশমেন্ট’ ও ‘অ্যালিয়েন’ শব্দদ্বয় ব্যবহার করেন। গত মাসে তিনি অভিযোগ করে বসেন, ২০০৮ সালে ভারতে যেই সন্ত্রাসী হামলায় ১৬৬ জন মানুষ নিহত হয়, তার নেপথ্যে ছিল সেনাবাহিনী। সাবেক জেনারেল তালাদ মাসুদ বলেন, তার এই বিস্ফোরক মন্তব্যের পূর্বে সেনাবাহিনী কখনই নিজের উচ্চাসন নিয়ে এতটা আতঙ্কিত বোধ করেনি।

এই বছরের শুরুতে পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে যেই পরোক্ষ নির্বাচন হয়েছে, তা থেকেই বোঝা যায় সেনাবাহিনী কীভাবে কাজ করে। দেশের চারটি প্রাদেশিক আইনসভা যখন নতুন সিনেটর নির্বাচন করবে, তার কয়েক সপ্তাহ আগে বেলুচিস্তান প্রদেশের সরকার ভেঙ্গে যায়। ওই প্রাদেশিক সরকার ছিল নওয়াজের পিএমএল-এন’র নেতৃত্বাধীন। হুট করে খোদ তার দলেরই কয়েকজন আইনপ্রণেতা পক্ষত্যাগ করলে ওই সরকারের পতন ঘটে। শরিফের একজন মিত্র দাবি করেন, এর নেপথ্যে ছিল আইএসআই।

যাই হোক। পরবর্তীতে দেখা যায়, পিএমএল-এন’র পক্ষত্যাগী আইনপ্রণেতারা স্বতন্ত্রদের সঙ্গে মিলে গঠন করেন সামরিক বাহিনী পন্থী দল বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি)। এই দল পরবর্তীতে সিনেটে বেলুচিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত আসনের বেশ কয়েকটি পেয়ে যায়। আর নতুন সিনেট সদস্যরা বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে মিলে সিনেট চেয়ারম্যান হিসেবে নওয়াজের দলের প্রার্থীকে হটিয়ে দেয়! অথচ, এই বিরোধী দলগুলোর মধ্যে এতদিন বিরোধ এতটাই তীব্র ছিল যে তাদের মধ্যে ঐক্য হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না।
উর্দু ভাষার একটি পত্রিকার প্রতিবেদনে উঠে আসে, কীভাবে সেনাবাহিনী ওই সিনেটরদেরকে নওয়াজের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিতে সহায়তা করে। সিনেট চেয়ারম্যান মনোনয়নে ব্যর্থ হয়ে নওয়াজের দল সংবিধানের একটি অস্পষ্ট অনুচ্ছেদ প্রত্যাহারে ব্যর্থ হয়। এই অস্পষ্ট অনুচ্ছেদ ব্যবহার করেই সুপ্রিম কোর্ট নওয়াজ শরিফকে বরখাস্ত করেছিল।

সেনাবাহিনী পন্থী বলে পরিচিত পিটিআই’র নেতা ইমরান খান অস্বীকার করেন না যে, সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে। তবে তার যুক্তি, আরও শক্তিশালী বেসামরিক সরকারই (তথা তার নেতৃত্বাধীন সরকার) এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারে। ইমরান হয়তো সরকার গঠনের পথ পেয়েও যেতে পারেন।

দেশের সবচেয়ে জনবহুল অঙ্গরাজ্য পাঞ্জাবে নওয়াজের দল থেকে পদত্যাগের হিড়িকে সবচেয়ে বেশি লাভ হয় ইমরানের দল পিটিআই’র। একান্ত আলাপচারিতায় অনেক রাজনীতিবিদ স্বীকার করেছেন যে তারাও চাপ পেয়েছেন। কাউকে আবার পিএমএল-এন না ছাড়লে দুর্নীতির অভিযোগ আনার হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

২০১৩ সালের নির্বাচনে পাঞ্জাবের ১৪৮টি আসনের মধ্যে ১১৬টিতে জয় পেয়েছিল নওয়াজের দল। তাই পাঞ্জাবে আসন বাড়াতে পারলে দেশের সম্ভাব্য জোট সরকারের নেতা হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে ইমরানের। সাবেক কূটনীতিক হোসেন হাক্কানি বলেন, এই ধরণের সরকার সেনাবাহিনীরও পছন্দের।

এদিকে এ সব কিছু নিয়ে যেসব সংবাদমাধ্যম সমালোচনায় মুখর ছিল, তারা বাণিজ্যিক সংকটের শিকার হয়েছে। দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় টিভি স্টেশন জিও টিভিকে রহস্যজনকভাবে ক্যাবল কোস্পানিগুলো প্রত্যাহার করে নেয়। পরবর্তিতে বিচারবিভাগের সমালোচনা ও নওয়াজ শরিফের প্রতি সমর্থনের তীব্রতা কমিয়ে দিলে ফের ফিরে আসে জিও। পিএমএল-এন’র সমর্থক সাংবাদিক গুল বুখারিকে সস্প্রতি কয়েক ঘণ্টার জন্য অপহরণ করা হয়। এই সপ্তাহে উদারপন্থী সংবাদপত্র ডন জানিয়েছে, দেশের বেশিরভাগ জায়গায় পত্রিকা পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না। এক সাংবাদিকের ভাষায়, ‘আমাদেরকে ১১০ ভাগ স্তব্ধ করে হয়েছে।’

তবে সেনাবাহিনীর পরিকল্পনার একমাত্র দৃশ্যমান প্রতিবন্ধকতা হলো নওয়াজ শরিফের প্রতি ভোটারদের সহানুভূতি। তার জনসভায় বিপুল লোকসমাগম হয়। গ্যালাপের জরিপে দেখা গেছে, জাতীয়ভাবে পিটিআই’র চেয়ে ১৩ পয়েন্টে এগিয়ে আছে পিএমএল-এন। সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাবে এগিয়ে আছে ২০ পয়েন্টে। রাওয়ালপিন্ডি শহরের গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার বাসিন্দা মুজাফফর মুগল বলেন, ‘আমরা জানি সামনের নির্বাচনে কারচুপি করার চেষ্টা করবে এস্টাবলিশমেন্ট। তবে আমি তাকে (নওয়াজ) ফের ভোট দেব।’
অনেক পাকিস্তানী ইদানিং সেনাবাহিনীর এমন সমালোচনা করেছেন যেটা আগে কখনই দেখা যায়নি। গত বছর গজিয়ে উঠেছে পুশতুন প্রোটেকশন মুভমেন্ট (পিটিএম) নামে একটি নাগরিক অধিকার সংগঠন। ইতিমধ্যেই খ্যাতি পাওয়া এই সংগঠন সেনাবাহিনীর জঙ্গিবাদবিরোধী অভিযানের প্রতিবাদ থেকে উদ্ভূত। পিটিএম’র দাবি, সস্প্রতি ২০ হাজার মানুষের গুম হওয়ার বিষয়টি তদন্ত করুক জাতিসংঘ। পাশাপাশি, পাকিস্তানের উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল যেখানে প্রায় ৩ কোটি পুশতুন বসবাস করেন, সেখান থেকে সামরিক চৌকি ও কার্ফিউ প্রত্যাহারেরও দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।

পিটিএম’র বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর প্রতিক্রিয়া ছিল প্রচ- তীব্র। সংগঠনটির ৩৭ জন কর্মীকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহে’র অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত মাসে একটি জনসভায় অংশ নিতে দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর করাচিগামী বিমানে চড়তে বাধা দেওয়া হয় পিটিএম’র জনপ্রিয় নেতা মনজুর পাশতিনকে। পরে তিনি দুই দিন গাড়ি চালিয়ে করাচি পৌঁছান। সেখানে তিনি দেখতে পান তার ১০ হাজার সমর্থক অন্ধকারে মাটিতে বসে আছে। কারণ, যেই কোস্পানির ওই অনুষ্ঠানে চেয়ার ও লাইট সরবরাহের কথা ছিল, তারা পিছু হটেছে। এটি ছিল স্রেফ আরেকটি ব্যাখ্যাতিত ঘটনা, যেমনটা সেনাবাহিনী-বিরোধী কর্মকান্ডে অহরহই ঘটে থাকে।

পুশতুন নন এমন মানুষও এখন পিটিএম’কে সমর্থন করা শুরু করেছেন। এ নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন সেনাবাহিনী। করাচির ওই জনসভায় বেলুচিস্তান থেকে অংশ নিয়েছিলেন ৬৬ বছর বয়সী এক নারী। বেলুচিস্তানেও সেনাবাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষোভ স্থানীয় বাসিন্দান্দের। ওই নারীকে সেই জনসভায় নিজের সন্তানের ছবি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তার ছেলে প্রায় এক বছর ধরে নিখোঁজ।

কিছু সেনা জেনারেল অবশ্য আরও নরম প্রতিক্রিয়া দেখানোর পক্ষে। দেরিতে হলেও গ্রেপ্তারকৃত পিটিএম-কর্মীদেরকে সস্প্রতি জামিন দেওয়া হয়েছে। এটিকে কেউ কেউ দেখছেন সেনাবাহিনীর নিরব পিছু হটার লক্ষণ হিসেবে। তবে রাজনীতি থেকে বৃহত্তর অর্থে সরে দাঁড়ানোর জন্য যেই সাহস প্রয়োজন, তা দৃশ্যত সেনাবাহিনীর নেই।