প্রচ্ছদ হেড লাইন ডেক্সামেথাসোনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যা বললেন বিশেষজ্ঞরা

ডেক্সামেথাসোনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নিয়ে যা বললেন বিশেষজ্ঞরা

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

কোভিড-১৯ এ গুরুতর অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসায় যে ডেক্সামেথাসোনকে কার্যকর হিসেবে বলছেন বিজ্ঞানীরা, সেই ওষুধটি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া গ্রহণ করলে মারাত্মক শারীরিক সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, ডেক্সামেথাসোন ব্যবহারে ভেন্টিলেটারে থাকা রোগীদের মৃত্যুর ঝুঁকি এক তৃতীয়াংশ কমানো যাবে। আর যাদের অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে, তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার এক পঞ্চমাংশ কমানো যাবে।

তারা বলছেন, বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোতে কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় এই ওষুধ বিশালভাবে কাজে লাগতে পারে।

গবেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের চেষ্টায় মানুষের শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা যখন অতি সক্রিয় হয়ে ওঠে, তখন শরীরের ভেতর যে ক্ষতিগুলো হয়, এই ডেক্সামেথাসোন সেই ক্ষতি কিছুটা প্রশমন করতে পারবে বলে তারা পরীক্ষায় দেখেছেন।

আর এই গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর দেশের কিছু এলাকায় ওষুধের দোকানে এই গ্রুপের ওষুধের বিক্রি তুলনামূলকভাবে বেড়ে গেছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে।

ঢাকার কয়েকটি ফার্মেসিতে কথা বলে জানা যায়, বিভিন্ন ওষুধ তৈরিকারী প্রতিষ্ঠান কমদামি এই স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ তৈরি করে এবং ফার্মেসিতে এই জাতীয় ট্যাবলেটের খুচরা মূল্য এক থেকে দুই টাকার মধ্যে।

কেন ব্যবহার করা হয় ডেক্সামেথাসোন জাতীয় ওষুধ?

তীব্র উপসর্গসহ করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ডেক্সামেথাসোন জাতীয় ওষুধ বাংলাদেশে মার্চ মাস থেকেই ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানান বাংলাদেশ মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক বিল্লাল আলম।

“বাংলাদেশে কোভিড-১৯ চিকিৎসার যে প্রথম গাইডলাইন প্রকাশ করা হয়, সেখানেই উল্লেখ করা হয় যে তীব্র উপসর্গসহ কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় ডেক্সামেথাসোন গ্রুপের স্টেরয়েডজাতীয় ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে,” বলেন বিল্লাল আলম।

তিনি জানান, এই জাতীয় ওষুধ কোন ধরণের রোগীকে কী মাত্রায় প্রয়োগ করতে হবে, তা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া প্রয়োগ করলে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

যদিও দেশে ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন ছাড়া অধিকাংশ ওষুধ বিক্রি করার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও হাতে গোনা কয়েকটি ফার্মেসি বাদে অধিকাংশ ফার্মেসিই এই নিয়ম মানে না। ফলে ফার্মেসিতে বিক্রি হওয়া ওষুধের একটা বড় অংশ রীতিবিরুদ্ধভাবে প্রেসক্রিপশন ছাড়া বিক্রি হয়।

শ্বাসকষ্ট জাতীয় সমস্যার ক্ষেত্রে, নিউমোনিয়া হলে, তীব্র অ্যাজমা থাকলে অনেকসময় চিকিৎসকরা এই ধরণের ওষুধ ব্যবহারের পরামর্শ দেন।

বিল্লাল আলম বলেন, “মানুষ মারা যাওয়ার আগেও অনেকক্ষেত্রে শেষ চেষ্টা হিসেবে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ দেয়া হয়ে থাকে।”

তবে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ভুল ব্যবহারে কী ধরণের স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে?

মেডিসিন সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক বিল্লাল আলম বলেন, “স্টেরয়েডের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হিসেবে হাইপার টেনশন হতে পারে, পেপটিক আলসার হতে পারে এবং ডায়াবেটিসের তীব্রতা বৃদ্ধি করতে পারে।”

“এছাড়া চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ গ্রহণ করলে মুখে, পেটে বা পায়ে পানি আসতে পারে, কিডনি বিকল হতে পারে এবং লিভার ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে।”

আর যাদের অন্যান্য স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রেও এই ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ঝুঁকি তৈরি করতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“কিডনি বা লিভারের সমস্যা বা ডায়বেটিস যাদের রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে এই ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া গুরুতর হতে পারে।”

এছাড়া শরীরে কোনো ধরণের ইনফেকশন থাকলে এই ওষুধ ব্যবহারে ইনফেকশন বেড়ে যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মূলত কোন মাত্রায় এই ওষুধ কোন ধরণের রোগীর জন্য ব্যবহার করতে হবে, সেই বিষয়টি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামতের সাপেক্ষে নির্ধারণ না করা হলে এসব স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশে কতটা সহজলভ্য এই ওষুধ?

স্টেরয়েডজাতীয় এই ওষুধ দুইভাবে বাংলাদেশের বাজার থেকে ক্রেতারা কিনতে পারেন বলে জানান বাংলাদেশ ঔষধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান।

“ইঞ্জেকশন পদ্ধতিতে শরীরে প্রবেশ করানোর ভায়াল ও ট্যাবলেট – এই দুইভাবে ফার্মেসি থেকে এই ওষুধটি কেনা সম্ভব। ৩৩টি ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ইঞ্জেকশনের তরলটি তৈরি করে, আর ২৯টি প্রতিষ্ঠান ট্যাবলেট তৈরি করে।”

মাহবুবুর রহমান জানান, একটি ইঞ্জেকশনের ভায়ালে ৫ মিলিগ্রাম প্রতি এমএল আয়তনে ওষুধ থাকে, যার মূল্য ১৩ থেকে ১৫ টাকা।

আর ট্যাবলেটের আয়তন হয়ে থাকে ০.৫ মিলিগ্রাম থেকে ১ মিলিগ্রাম, যার দাম ৭৫ পয়সা থেকে দুই টাকার মধ্যে।

‘অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার রোধে জনসচেতনতা তৈরি করা জরুরি’

ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের মহাপরিচালক মাহবুবুর রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করেন, করোনাভাইরাসের চিকিৎসায় ডেক্সামেথাসোন কার্যকর – এই তথ্য ছড়িয়ে পড়ায় ওষুধের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে মানুষ অতিরিক্ত পরিমাণে এই ওষুধ মজুদ করতে পারে, যার ফলশ্রুতিতে এর দাম বাড়তে পারে।

“কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি মানুষ আতঙ্কিত হয়ে অক্সিজেন মজুদ করছিল এবং বাজারেও অসাধু ব্যবসায়ীরা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অক্সিজেনের দাম বাড়িয়ে দিয়েছিল। এই ওষুধের ক্ষেত্রেও সেই ধরণের পরিস্থিতি তৈরি হতেই পারে।”

বাজারে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে অধিদফতরের মনিটরিং টিম কাজ করবে বলে জানান তিনি।

পাশাপাশি ফার্মেসিগুলোও যেন নীতিমালা ভঙ্গ করে প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি না করে, তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করা হবে।

আর মানুষ যেন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়া এই ওষুধ ব্যবহার না করে, সেসম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে সংবাদমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি দেয়ার কথা ভাবছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর।

“ওষুধের সম্পর্কে মানুষকে জানাতে আমরা গণমাধ্যমের সাহায্য নেয়ার কথা ভাবছি, কারণ এই ওষুধের ভুল ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝূঁকিপূর্ণ হতে পারে।”

ডেক্সামেথাসোন সম্পর্কে সাম্প্রতিক গবেষণার ফল গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর এই ওষুধের চাহিদা হঠাৎ করে বেড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। আর ভবিষ্যতে চাহিদা আরো বাড়লে বাংলাদেশের ওষুধ নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডেক্সামেথাসোন উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশনাও দেয়া হতে পারে বলে মন্তব্য করেন মাহবুবুর রহমান।

“করোনাভাইরাস পরিস্থিতির ভবিষ্যতে আরো অবনতি হলে আমাদের হয়তো আরো বেশি পরিমান ডেক্সামেথাসোন প্রয়োজন হবে। সেই দিকটি বিবেচনা করে আমরা ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদ দিতে পারি।”

সূত্র : বিবিসি