প্রচ্ছদ হেড লাইন চতুর্থ স্তরে যাচ্ছে দেশ : বৃহৎ ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের’ শঙ্কা

চতুর্থ স্তরে যাচ্ছে দেশ : বৃহৎ ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের’ শঙ্কা

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

চীনের উহান প্রদেশ থেকে মহামারী করোনা ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মরণঘাতী ভাইরাসটির থাবায় ক্ষতবিক্ষত পুরো দুনিয়া। রক্ষা পায়নি বাংলাদেশও। দেশে ভাইরাসটি হানা দেয়ার এক মাস পেরিয়েছে গতকাল বুধবার।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে দেশে ২১৮ জন ব্যক্তির শরীরে করোনার উপস্থিতি নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। মরণঘাতী ভাইরাসে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২০ জন। আর আক্রান্তদের মধ্যে এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ৩৩ জন।

প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর পরীক্ষার হার যত বাড়ছে, রোগীর ও মৃত্যুর সংখ্যাও অনেকটা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে। সংখ্যায় কম হলেও আশঙ্কজন খবর হচ্ছে মৃত্যুর হার কম হলেও ইতালির পর বাংলাদেশের অবস্থান। অর্থাৎ মৃত্যুর হারে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

তবে নমুন পরীক্ষার হার কম হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক মাধ্যমেও এ নিয়ে সমালোচনা তৈরি হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরীক্ষা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু সেটাই এখনো প্রকৃত চিত্র কিনা বলা যাবে না। কারণ আমরা পরীক্ষা কেন্দ্র সবেমাত্র বাড়িয়েছি। এই যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে পরীক্ষার সংখ্যা আরো বড়লে হয়তো আসল চিত্রটা বোঝা যাবে।

এছাড়াও ছড়িয়ে পড়েছে ভাইরাসটির ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’। সীমিত সম্বল নিয়ে করোনাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুরো বাংলাদেশকে। খোদ স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ অতিমাত্রায় ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশের প্রস্তুতিতে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে না।

করোনার প্রস্তুতি নিয়ে বাংলাদেশে করোনা হানা দেয়ার আগেই বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে জোরালোভাবে। কিট সঙ্কট, চিকিৎসকদের পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট, হাসপাতালের প্রস্তুতি, আইসোলেশন, ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ’ চরম মাত্রায় সঙ্কট, দেশের মানুষের মৌলিক চাহিদার নিশ্চয়তা দিতে প্রস্তুতিসহ অনেক বিষয়েই সংশয় রয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির এখন ক্রান্তিকাল। দেশ সংক্রমণের তৃতীয় স্তর থেকে চতুর্থ স্তরের দিকে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, রোগ সংক্রমণের চতুর্থ স্তরে পৌঁছানোর অর্থ হলো- করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হবে বহু মানুষ, বহু মানুষকে হাসপাতালে যেতে হবে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়বে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও এর ব্যাপকতার ওপর ভিত্তি করে বিশ্বের দেশগুলোকে চারটি স্তরে ভাগ করেছে। একজনেরও সংক্রমণ শনাক্ত না হওয়া দেশ স্তর-১-এ। বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তি শনাক্ত হওয়া ও তাদের মাধ্যমে দু-একজনের সংক্রমণ, স্তর-২। নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় সংক্রমণ সীমিত থাকলে তা স্তর-৩। আর স্তর-৪ হলো সংক্রমণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া।

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের লিভার বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)   বলেন, বাংলাদেশে ইতোমধ্যে করোনার কামিউনিটি ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বাড়ানোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে। এটা নিসন্দেহে চিন্তার বিষয়।

তবে দেশে করোনা এখনো অনেক দেশের তুলনায় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আগামী দিনগুলো কেমন হবে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগামী দিনগুলো অস্তে অস্তে খারাপ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে কতটা খারাপ হবে নির্ভর করবে আমাদের উপর। আমরা যদি সরকারের নির্দেশনা মেনে চলি এবং লকডাউনের দিনগুলোতে ঘরে থাকি তাহলে আমরা করোনাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে পারব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক সাইফুল্লাহ মুন্সি বলেন, পশ্চিমা দেশ নয়, আমরা ভারত বা ব্রাজিলের সঙ্গে যদি তুলনা করি, তখন কিন্তু দেখা গেছে এ রকম একটা পর্যায়ে এসে তাদের রোগীর সংখ্যা বহু হাজার ছাড়িয়ে গেছে। আমাদেরও হয়তো কিছুদিনের মধ্যে সে রকম একটা চিত্র দেখতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে আমরা সেজন্য প্রস্তুত কিনা? আমরা হয়তো রোগী শনাক্ত করতে সক্ষম হব, কিন্তু পেশেন্ট ম্যানেজমেন্টের জন্য আমাদের স্বাস্থ্য খাত কতটা প্রস্তুত হয়েছে? আমাদের কি যথেষ্ট আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, চিকিৎসক প্রস্তুত রয়েছে কিনা। রোগী সামলানোর ব্যাপারটি হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

তিনি বলেন, পরীক্ষা বড়ার সঙ্গে সঙ্গে রোগীর সংখ্যা বড়ছে। কিন্তু সেটাই এখনো প্রকৃত চিত্র কিনা বলা যাবে না। কারণ আমরা পরীক্ষা কেন্দ্র সবেমাত্র বাড়িয়েছি। এই যে ট্রেন্ড দেখা যাচ্ছে, তাতে পরীক্ষার সংখ্যা আরো বড়লে হয়তো আসল চিত্রটা বোঝা যাবে।

ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক বেনজীর আহমেদ বলছেন, যেভাবে সবকিছু হওয়া উচিত ছিল, সেটা হয়নি। কোয়ারেন্টাইনের কথাই যদি বলেন, বিদেশ থেকে যারা এসেছেন, তাদের কোয়ারেন্টাইন ঠিকভাবে নিশ্চিত করা যায়নি। এমনকি অনেকের নাম ঠিকানাও ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা যায়নি। প্রথমেই আমরা সেই সুযোগটা মিস করেছি। টেস্ট করার সক্ষমতা থাকার পরও এতদিন পরে টেস্ট বাড়ানো হয়েছে। প্রথম থেকে যদি সেটা করা হতো, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে ধরা যেত, ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সেটাও ঠিক সময়ে করা হয়নি।

যাদের শনাক্ত করা হয়েছে, তাদের কন্টাক্ট ট্রেসিংও ঠিকভাবে হয়নি। তিনি কোথায় কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে মিশেছেন, কি করেছেন, সব বিশ্লেষণ করা উচিত ছিল। তাহলে ঝুঁকি অনেক কমত। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি- সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে সেটা করা উচিত ছিল।

তিনি বলেন, যারা শনাক্ত হচ্ছেন, তাদের ঠিকভাবে চিকিৎসা করা, সংক্রমিতদের সীমাবদ্ধ করে রাখার বিষয়টি জরুরি। যারা হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছেন, নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাদের প্রশিক্ষণ সুরক্ষার ব্যাপারগুলো নিশ্চিত করা জরুরি। না হলে হাসপাতালগুলো বা চিকিৎসকরা সংক্রমিত হতে শুরু করলে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য অনেক হুমকি তৈরি করবে। বাংলাদেশে প্রথম করোনা ভাইরাস রোগী শনাক্ত করা হয় ৮ মার্চ।

সেদিন রোগতত্ত, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজন রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন নারী ও দুইজন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুইজন ইতালি থেকে সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছেন। অপর একজন তাদের সংস্পর্শে এসে আক্রান্ত হয়েছেন। তাদের বয়স ২০ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে।

তিনি জানিয়েছিলেন, আক্রান্তদের মধ্যে দুইজন ব্যক্তি দেশের বাইরে থেকে এসেছেন। দেশে আসার পর তাদের লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা দিলে তারা আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন। পরে তাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হলে করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। ইতালি থেকে আসা ওই দুইজন দুইটি আলাদা পরিবারের সদস্য।

তাদের নমুনা সংগ্রহের সময় পরিবারের আরো চারজনের নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সেই চারজনের মধ্যে একজন নারীর করোনা ভাইরাস ধরা পড়ে। এই ঘোষণা আসার পর মাস্ক, স্যানিটাইজারের তীব্র সঙ্কট দেখা দেয়। অতিরিক্ত দাম রাখার কারণে বেশ কয়েকটি ফার্মেসি সিলগালা করে দেয় ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর পরবর্তী কয়েকদিন ধরে আর নতুন কোনো রোগী পাওয়ার খবর জানায়নি আইইডিসিআর।

১১ এপ্রিল সংস্থাটি জানায়, যে তিনজন ব্যক্তি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে দুইজন সুস্থ হওয়ার পথে। আরেকটি পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলে তারা সুস্থ জানিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হবে। একই দিন করোনা ভাইরাসকে মহামারী বলে ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

১৩ মার্চ আইইডিসিআর জানায়, করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত তিনজনের মধ্যে একজন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। নতুন রোগী পাওয়া যায়নি। তবে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহ হলে যোগাযোগের জন্য বেশ কয়েকটি হটলাইন নম্বর চালু করা হয় সংস্থাটির পক্ষ থেকে। তবে অনেকেই অভিযোগ করেন, বারবার চেষ্টা করেও তারা এসব হটলাইনে সংযোগ স্থাপন করতে পারেননি।

হাসপাতাল আছে, প্রস্তুতি নেই: করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসায় ঢাকায় পাঁচটি হাসপাতাল প্রস্তুত করার ঘোষণা দেয়া হয় বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের পক্ষ থেকে। হাসপাতালগুলো হলো- মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মহানগর জেনারেল হাসপাতাল, সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল ও কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল।

কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয় যে, এসব হাসপাতালে প্রস্তুতির এখনো অনেক বাকি। অনেক হাসপাতাল রোগী ভর্তি করতে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত লাগবে বলে জানায়। অনেক রোগী অভিযোগ করেন, ঠাণ্ডা, সর্দি-কাশি বা নিউমোনিয়ার মতো রোগে তারা সাধারণ হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না। করোনা ভাইরাস সন্দেহে একের পর এক হাসপাতালে ঘুরে বিনা চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে।