প্রচ্ছদ হেড লাইন আলোচনায় ছিল খুন-ধর্ষণ কমেছে ক্রসফায়ার

আলোচনায় ছিল খুন-ধর্ষণ কমেছে ক্রসফায়ার

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

করোনাকালে বছরের মাঝামাঝিতে কক্সবাজারে চেকপোস্টে পুলিশের হাতে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ হত্যাকা- সারা দেশকে থমকে দিয়েছিল। সিনহা হত্যার পর ক্রসফায়ারের ঘটনা কমে যায় নাটকীয়ভাবে। তবে হত্যাকা- থেমে থাকেনি। হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে এএসপি আনিসুল হত্যা, ধর্ম অবমাননার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনিতে শহিদুন্নবী জুয়েল হত্যা কিংবা সিলেটে পিটিয়ে রায়হানকে হত্যার পর পুলিশের এসআইয়ের গণপিটুনির নাটক ছিল আলোচিত।

বিভাগীয় কয়েকটি শহরে বেড়েছে কিশোর অপরাধের সংখ্যা। রক্ষককে ভক্ষকের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে। গুজব রটিয়ে, মিথ্যা ট্যাগ দিয়ে জনসম্মুখে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা ২০২০ সালে দেখেছে দেশের মানুষ। এসব ঘটনা বিভিন্ন সময়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে, তা দেখে স্বাভাবিক থাকা অসম্ভব হয়ে যায় অনেকেরই। এমন একেকটি

হত্যাকা- দেশের বিবেকবান প্রতিটি মানুষের হৃদয়কে নাড়িয়ে দিয়েছে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদ- করা হলেও ধর্ষণের ঘটনা চলতি বছরে বেড়েছে। বছরের প্রথম ১১ মাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৫৪৬টি।

ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুল হক আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, তদন্ত ও বিচারে দীর্ঘ সময় লাগলে আসামিরা ভুক্তভোগীর ওপর প্রভাব খাটানোর সুযোগ পায়। তাই অনেক ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী বাধ্য হয়ে মামলা থেকে সরে যায় কিংবা মীমাংসা করে ফেলে। মামলার তদন্ত ও বিচার শেষ করে আসামির দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে অপরাধ কমবে না। আইন প্রয়োগের পাশাপাশি রাজনৈতিক সামাজিক এবং পারিবারিকভাবে এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে, তার প্রতিকারে আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।

গোয়েন্দা তথ্য ও অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরে ঢাকা, চাট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগর অঞ্চলে কিশোর অপরাধ বেড়েছে। করোনার মহামারি কালেও বেড়েছে লোমহর্ষক হত্যাকা-ের সংখ্যা। ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- করা হলেও তাতে ধর্ষণের সংখ্যা কমেনি। চলতি বছরের এপ্রিল ও মে মাসের তুলনায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ধর্ষণ ও নারীর বিরুদ্ধে গৃহস্থালি সহিংসতার ঘটনা বেড়েছে

মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেছেন, ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে হত্যার পর ক্রসফায়ারের সংখ্যা কমেছে। তবে দেশে সামগ্রিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। করোনা মহামারির কারণে অনেকে চাকরি ও আয়ের উৎস হারিয়েছে। এ রকম পরিস্থিতিতে খুন, ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা, চুরি ও অলিগলিতে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার অভাব ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি কার্যকর না হওয়ায় খুন-ধর্ষণের মতো ঘটনা বাড়ছে। বছরের পর আদালতের মামলা চলায় ভুক্তভোগীরা বিচার পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে পড়ছে। মামলার সাক্ষী হাজিরে অনীহা এবং আলামতও নষ্ট হওয়ার ফলে সাজা পাওয়ার হার খুবই কম। দীর্ঘসূত্রিতা এবং বিচারহীনতার কারণে ভুক্তভোগীরা অধিকাংশ মামলা করতেই চায় না। এসব ঘটনার দ্রুত বিচার হয়ে দৃষ্টান্তমূলক সাজা হলে অপরাধীরা ভয় পেতে এবং খুন-ধর্ষণের মতো অপরাধ কমে যেত।

মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বলছে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ২০১৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৭৬ জনকে। আর ২০২০ সালের ১১ মাসেই ধর্ষণের শিকার হয় ১ হাজার ৫৪৬ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫১ জনকে। ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ৭৩২ জন। ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হন ৮১৮ জন নারী। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৭ বছর বয়স থেকে ১৮ বছরের শিশু-কিশোরীরা।

বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সালমা আলী বলেন, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা না থাকা এবং জবাবদিহিতা-স্বচ্ছতার অভাব ধর্ষণের ঘটনা বেড়ে যাওয়ার একটি বড় কারণ। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলার দীর্ঘসূত্রিতা, ভিকটিম সুরক্ষার নির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। আমাদের ভালো ভালো আইন আছে কিন্তু তার বিধি নেই। এখন পাশের বাড়ির লোকজনেরও খবর রাখে না কেউ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব ধরনের ভিডিওচিত্র বিনা বাধায় দেখতে পারছে সব স্তরের লোকজন। অনেক ধরনের ভিডিওচিত্র বিকৃত যৌনচারে উৎসাহ জোগায় কাউকে কাউকে। তিনি বলেন, পুলিশ অনেক দেরি করে মামলা করে, যাতে অনেক সময় আসামিরা পার পেয়ে যান। নীতি নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন প্রজন্ম গড়ে তোলার পাশাপাশি বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসার ওপর জোর দেন তিনি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন বলছে, চলতি বছরের ১১ মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন ২২০ জন। এর মধ্যে প্রথম সাত মাসে ক্রসফায়ারে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ২১০ জন। তবে ৩১ জুলাই অবসরপ্রাপ্ত সেনা মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান ক্রসফায়ারে মৃত্যুর পর পরবর্তী ৪ মাসে মাত্র ১০ জন ক্রসফায়ারে মারা গেছে। ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত ক্রসফায়ারের সংখ্যা ছিল ১৬০ জন। জুলাই মাসে ৫০ জন ক্রসফায়ারের শিকার হয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ২১০ জনে। আগস্টে ক্রসফায়ারে মারা যান তিনজন, সেপ্টেম্বরে তিন, অক্টোবরে তিন এবং সর্বশেষ নভেম্বরে ক্রসফায়ারে মারা গেছেন একজন।

২০২০ সালে আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল- কক্সবাজারে পুলিশ চেকপোস্টে মেজর সিনহা হত্যা, রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে কর্মীদের মারধরে জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম হত্যা এবং ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে সিলেটে মেট্রোপলিটনের বন্দরবাজার ফাঁড়ির মধ্যে রায়হান আহমেদ নামের এক যুবককে হত্যা। এছাড়া লালমনিরহাটে মসজিদের ভেতরে কোরআন শরিফ অবমাননার গুজব রটিয়ে জুয়েল নামের এক মুসল্লিকে জ্যান্ত পুড়িয়ে হত্যা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

মেজর সিনহা হত্যা : চলতি বছরের গত ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের চেকপোস্টে অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা গাড়ি থেকে বের হলে তাকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। পরে আদালতের নির্দেশে মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পায় র‌্যাব। এই হত্যার ঘটনায় ৫ আগস্ট নিহতের বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার কক্সবাজারের আদালতে মামলা দায়ের করেন। মামলায় ওসি প্রদীপসহ ৯ জনকে আসামি করা হয়। হত্যাকা-ের সময় সিনহার সঙ্গে কক্সবাজারে ডকুমেন্টারি তৈরির কাজ করছিলেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির তিন শিক্ষার্থী শিপ্রা দেবনাথ, সাহেদুল ইসলাম সিফাত এবং তাহসিন রিফাত নূর। পরে পুলিশ তাদেরও গ্রেপ্তার করে। পুলিশ বাদী হয়ে তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করে। গত ১৩ ডিসেম্বর একই আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাবের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। মামলায় যে ১৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয় তার মধ্যে ১৪ জন গ্রেপ্তার আছে বলে চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়।

সিলেটে পুলিশের হাতে রায়হান হত্যা : গত ১১ অক্টোবর ভোরে সিলেট মেট্রোপলিটনের আখালিয়া এলাকার বাসিন্দা রায়হান আহমদকে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নিয়ে ছিনতাইকারী আখ্যা দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় যুবক রায়হানকে। এ ঘটনায় নিহত রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার তান্নী বাদী হয়ে পরের দিন ১২ অক্টোবর কোতোয়ালি থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। রায়হান হত্যাকা-ে বন্দরবাজার ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আকবরসহ পাঁচজনকে সাময়িক বরখাস্ত এবং তিনজনকে প্রত্যাহার করা হয়। এরপর সর্বশেষ গত ১৮ নভেম্বর রায়হান আহমদ হত্যা মামলায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক সৌমেন মিত্র এবং এসআই আবদুল বাতেন ভূঁইয়াকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পুলিশের সদর দপ্তরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে সদর দপ্তরের তদন্ত দলের প্রতিবেদনের পর তাদের বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয় বলে বলে জানা গেছে। এর আগে গত ৯ নভেম্বর দুপুরে কানাইঘাটের ডোনা সীমান্ত এলাকা থেকে মামলার প্রধান আসামি এসআই আকবর হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

ধর্ম অবমাননার গুজবে পুড়িয়ে হত্যা : গত ২৯ অক্টোবর কোরআন শরিফ ‘অবমাননার’ গুজব ছড়িয়ে লালমনিরহাটের পাটগ্রামের বুড়িমারী ইউনিয়ন পরিষদের ভেতরে আবু ইউনুস মো. শহিদুন্নবী জুয়েল (৪৫) নামের এক মুসল্লিকে হত্যা করা হয়। এরপর তার শাল লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের ওপর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, ঘটনার দিন ওই মসজিদে আছরের নামাজের পর জুয়েল নামের ব্যক্তি ধর্মের অবমাননা করেছেনÑ এমন গুজব ছড়িয়ে পড়লে শত শত মানুষ জড়ো হয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করে। জুয়েলকে পিটিয়ে হত্যা এবং তার রক্তাক্ত লাশে আগুন দিয়ে পোড়ানোর ভিডিও সামাজিক মাধ্যম ফেইসবুকে ভাইরাল হলে দেশ-বিদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে।

পুলিশের এএসপি আনিসুল হত্যা : মানসিক সমস্যার চিকিৎসায় সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে ৯ নভেম্বর জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটে নিয়ে যান স্বজনরা। এরপর সেখান থেকে তাকে আদাবরের মাইন্ড এইড নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ভর্তির কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি প্রতিষ্ঠানটির কর্মচারীদের মারধরের শিকার হন। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। সিসিটিভির ফুটেজে এই হত্যাকা-ের দৃশ্য ছড়িয়ে পড়লে সারা দেশে আলোচিত হয়। এ ঘটনায় আসামিদের মধ্যে ১২ জনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে।