প্রচ্ছদ এক্সক্লুসিভ সংবাদ সংযমের মাসে কেন আমরা এতো অসংযমী?

সংযমের মাসে কেন আমরা এতো অসংযমী?

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

রোজার মূল তাৎপর্য সংযমে। বছর ঘুরে রোজা আসে সে সংযম শেখাতে। শুধু ক্ষুধার সংযম নয়, মুখের সংযম, কানের সংযম, মনের সংযমসহ সব রিপু দমনের প্রশিক্ষণকেই রোজা বলে। রোজা মানুষকে সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। আমাদের সামগ্রিক জীবনে উন্নতি, অগ্রগতির জন্য সংযমের কোনো বিকল্প নেই।

রোজার মূল তাৎপর্য সংযমে। বছর ঘুরে রোজা আসে সে সংযম শেখাতে। শুধু ক্ষুধার সংযম নয়, মুখের সংযম, কানের সংযম, মনের সংযমসহ সব রিপু দমনের প্রশিক্ষণকেই রোজা বলে। রোজা মানুষকে সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। আমাদের সামগ্রিক জীবনে উন্নতি, অগ্রগতির জন্য সংযমের কোনো বিকল্প নেই।

বছর ঘুরে এক মাসের জন্য আগমন করে পবিত্র রমজান মাস। এ মাসে রোজা পালন করা বান্দার ওপর আল্লাহর পক্ষ থেকে ফরজ বিধান। এ ফরজ বিধানের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো সংযম। এজন্য রমজান মাসকে সংযমের মাসও বলা হয়। সংযম সাধনার একটি সুবর্ণ সুযোগ হলো এ মাস। নিজের বিরুদ্ধে, নফস, রিপু ও লালিত কামনা-বাসনার বিরুদ্ধে নিরলস সাধনা করার মাস হলো এ মাস। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘প্রকৃত মুজাহিদ তো সে-ই, যে তার নিজের নফস ও রিপুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে।’ (মুসনাদে আহমাদ)।
মাহে রমজানে ত্যাগ ও সংযম সাধনার প্রতি গুরুত্ব আরোপ করে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘পাঁচটি বিষয় রোজাদারের রোজা বিনষ্ট করে দেয় : মিথ্যা বলা, কূটনামি করা, পশ্চাতে পরনিন্দা করা, মিথ্যা শপথ করা এবং খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো।’

এজন্য রোজাদারকে কু-কথা শ্রবণ করা থেকে নিজের কানকে বিরত রেখে সাধনা করতে হবে। কেননা, যেসব কথা বলা হারাম, সেগুলো শ্রবণ করাও হারাম। এ জন্যই মিথ্যা শ্রবণকারী ও হারাম ভক্ষণকারীদের হাদিসে পাশাপাশি উল্লেখ করা হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘গিবতকারী ও শ্রবণকারী উভয়ই গুনাহের অংশীদার।’

দৈনন্দিন জীবনে আমরা নানা অনিয়ম, অসংযমী কাজ করে ফেলি। আমরা অধৈর্য হয়ে পড়ি এবং অন্যায় বা গুনাহের কাজে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি। অনেক সময় আমরা বিপদে পড়েও ধৈর্য হারিয়ে ফেলি। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার কিংবা নিজেকে শোধরানোর উত্তম সময় হচ্ছে মাহে রমজান। বাস্তব জীবনে আমাদের ধৈর্যের প্রয়োজন অনেক বেশি। ধৈর্য ধারণ করতে পারলে আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জন্য পুরস্কারের সুসংবাদ দিয়েছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন, সবরকারীদের সুসংবাদ দিন যারা বিপদগ্রস্থ হলে বলে, অবশ্যই আমরা আল্লাহর জন্য এবং তাঁরই দিকে আমাদের ফিরে যেতে হবে।’ (সূরা : বাক্বারা)।

একটি হাদিসে রোজাকে সংযম তথা সবরের অর্ধেক বলা হয়েছে। রাসূলে করিম (সা.) ইরশাদ করেন- ‘রোজা ধৈর্যের অর্ধেক।’ (তিরমিজি)। এতে বোঝা যায়, রমজানের সঙ্গে সংযম ও ধৈর্যের মূল অর্থ আর তাৎপর্যের মিল রয়েছে। আল্লাহ যেসব কাজ নিষিদ্ধ করেছেন তা থেকে বিরত থাকা হচ্ছে ধৈর্যের অর্ধেক। অপর অর্ধেক হচ্ছে তাঁর আনুগত্য বা ইবাদত করা।

যার সংযম ও ধৈর্য বেশি, তার পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে শান্তি বেশি। কোনো কিছু হারিয়ে গেলেও ধৈর্য ধারণ করতে হবে। অভাব-অনটনে পড়লে হারাম আয়ের দিকে না গিয়ে সীমিত হালাল রোজগারের ওপর সংযম ধারণ করতে হবে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যারা আল্লাহকে ভয় করে ও তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে, তিনি তাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করবেন এবং এমনভাবে রিজিক দান করবেন, যা সে কল্পনাও করতে পারবে না।’

ধৈর্য সংযম হচ্ছে মুমিনের সাফল্যের চাবিকাঠি। হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন- ‘যে সবর করে আল্লাহ তাকে সবর ধারণে সাহায্য করেন। আল্লাহ সবরের চাইতে উত্তম ও প্রশস্ততা কাউকে দান করেন না।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

মাহে রমজানে এই তিন ধরনের ধৈর্য পাওয়া যায়। কেননা, রমজানে আল্লাহর আদেশের আনুগত্য করা এবং নিষিদ্ধ ও হারাম কাজ থেকে বিরত থাকার কষ্ট আছে। এছাড়া ক্ষুৎ-পিপাসা, শারিরীক দুর্বলতাসহ ভাগ্যলিপির কষ্টও রয়েছে। এ জন্য রমজানকে সংযমের মাস বলা হয়েছে। তাই এ মাসে সংযমের প্রশিক্ষণ নিতে হবে এবং পরবর্তীতে তার বাস্তবায়ন করতে হবে।

আর এ সংযম জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে পালন করাই হচ্ছে রোজার শিক্ষা। কারণ, রোজার মূল তাৎপর্য সংযমে। বছর ঘুরে রোজা আসে সে সংযম শেখাতে। শুধু ক্ষুধার সংযম নয়, মুখের সংযম, কানের সংযম, মনের সংযমসহ সব রিপু দমনের প্রশিক্ষণকেই রোজা বলে। রোজা মানুষকে সংযমী হওয়ার শিক্ষা দেয়। খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা, কথাবার্তা, কর্মতৎপরতাসহ ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে সংযমী হওয়ার মহান বার্তা নিয়ে মুসলিম পরিবারে রমজানের আগমন ঘটে। না খেয়ে থাকার নামাই রোজা নয়; বরং মিথ্যাচারিতা, আজেবাজে, অহেতুক কথা বলা, চোখের গিবত এবং কটু বাক্য হতে জিহ্বাকে সংযত রাখা, প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের হেফাজত করা এবং হারাম মাল না খাওয়া সর্বক্ষেত্রেই সংযত হওয়ার নাম রোজা। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘মন্দ বিষয়ের প্রতি দৃষ্টিপাত করা শয়তানের একটি বিষ মিশ্রিত তীর। যে আল্লাহর ভয়ে এটা বর্জন করে, আল্লাহ তাকে ঈমানের এমন নূর প্রদান করেন, যার আস্বাদন সে অন্তরে অনুভব করে।’

কিন্তু আমরা রমজান উপলক্ষে রোজা পালনের এই মৌসুমে অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সংযম কি করতে পারি? অর্থনৈতিক ক্ষেত্রটা আমাদের এই বাংলাদেশে এতোটাই নাজুক যে, অন্যান্য দেশগুলোতে রমজানে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই পণ্যদ্রব্যের দাম কমায় আর আমাদের দেশে রমজান উপলক্ষে প্রতিযোগিতা করে ভোগ্যপণ্যসহ সবকিছুর দাম বৃদ্ধি করা হয়, কিন্তু কেন? বাংলাদেশের জন্য রমজান কি সংযমের মাস নয়?

মানুষকে জিম্মি করে অধিক মুনাফার প্রত্যাশায় পণ্যের মজুদ করাকে ইসলাম ধর্ম অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি ৪০ দিনের খাবার মজুদ রাখে, সে আল্লাহ প্রদত্ত নিরাপত্তা থেকে বেরিয়ে যায়।’ হাদিসে এটাও বলা আছে, ‘যে ব্যক্তি (সংকট তৈরি করে) খাদ্যশস্য গুদামজাত করে, সে অপরাধী।’ ভেজাল মেশানো বন্ধে উম্মতদের সতর্ক করে দিয়ে মহানবী (সা.) আরো বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কাউকে ধোঁকা দেয়, সে আমার উম্মত নয়।’

কী করলে রোজা ভাঙবে, কী করলে রোজা পোক্ত হবে; তার বিস্তারিত বিবরণ আছে শরীয়তে। কিন্তু আমরা খালি সকাল-সন্ধ্যা উপোস থাকাকেই রোজা হিসেবে ধরে নিয়ে আত্মপ্রসাদে ভুগি। মুখে বলিও, এবার অনেক গরম পড়েছে, এবার দিন বড়, রোজা রাখতে অনেক কষ্ট হচ্ছে।

অনেক লোক আছে, রোজা রেখে সারাদিন সময় কাটান হিন্দি সিনেমা দেখে। চিত্তের সংযম তিনি কতটা রাখতে পারছেন? রোজা রেখে ঘুষ খান, মিথ্যা কথা বলেন, মানুষের ক্ষতি করেন, দুর্নীতি করেন; এমন মানুষ তো ভূরি ভূরি। বরং রমজান এলে ঘুষের রেট বেড়ে যায়। পুলিশের ঈদ বাণিজ্য চলে দেদারসে। ইফতার পার্টির নামে মাসজুড়ে চলে দারুণ রাজনীতি। এসব আয়োজনে রাজনীতিবিদরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সত্য-মিথ্যা নানা অভিযোগ তোলেন।

আমাদের সামগ্রিক জীবনে উন্নতি, অগ্রগতির জন্য সংযমের কোনো বিকল্প নেই। আর এই গুণাবলী অর্জনের বা চর্চার উত্তম সময় হচ্ছে রমজান মাস। রমজান মাসে আমরা সংযম শিখে সারা বছর জীবনের প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সংযমী হয়ে চলবো। উল্টো সংযমের এই মাসেই আমরা অসংযমী হয়ে পড়ি! আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে সংযমের মাস রমজানে অসংযমী হবার এবং রোজা থেকে সংযম শিক্ষা নিয়ে সারা বছর সংযমী হয়ে চলার তাওফিক দান করুন। আমীন।