প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক শেষ বেলায় কংগ্রেসকেই মোদির মূল আক্রমণ

শেষ বেলায় কংগ্রেসকেই মোদির মূল আক্রমণ

যে দলটির অস্তিত্ব ভারত থেকে মুছে দিতে চেয়েছিলেন, ভোটের শেষ বেলায় সেই কংগ্রেসকেই কেন আক্রমণের মূল লক্ষ্য করে তুলেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি? দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে তাহলে কি কংগ্রেসকেই তিনি পথের কাঁটা বলে ধরে নিচ্ছেন? প্রশ্নটি রাজনৈতিক মহলকে আলোড়িত করে তুলেছে।

নরেন্দ্র মোদি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে প্রথম আক্রমণ করেন পঞ্চম দফার ভোটের ঠিক আগে। বলেন, উনি যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁর স্তাবকেরা তাঁকে ‘মিস্টার ক্লিন’ বলতেন। সেই মানুষটিই হয়ে দাঁড়ান ‘এক নম্বর ভ্রষ্টাচারী’। এই মন্তব্য ঘিরে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় বয়ে গেলেও প্রধানমন্ত্রী তাঁর মন্তব্য ফিরিয়ে তো নেনইনি, বরং তিনি যে ভুল কিছু বলেননি, তা প্রমাণে সচেষ্ট। তাঁর হয়ে সাফাই গান অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলিও।

দেশ এ বিতর্কে সরগরম হলেও মোদি নতুন একটি বিষয়ের উত্থাপন করে রাজীবকে আক্রমণ অব্যাহত রাখেন। গত বুধবার রাজধানীর রামলীলা ময়দানে দিল্লির প্রথম জনসভায় তিনি টেনে আনেন ২৬ বছরের পুরোনো একটি বিষয়। রাহুল গান্ধীর নাম না নিয়ে তাঁকে ‘নামদার’ বলে অভিহিত করে মোদি বলেন, ‘নামদারের অভিযোগ, আমি নাকি সেনাবাহিনীকে ব্যক্তিগত সম্পত্তি করে ফেলেছি। কিন্তু আজ জানাচ্ছি, সেনাদের কে ও কারা ব্যক্তিগত সম্পত্তি করেছিলেন। রাজীব গান্ধী। প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় ‘আইএনএস বিরাট’ যুদ্ধজাহাজে চেপে গোটা পরিবার নিয়ে তিনি ১০ দিন ছুটি কাটিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজনও। দেশের যুদ্ধজাহাজকে তিনি ট্যাক্সির মতো ব্যবহার করেছিলেন।’

সোনিয়া গান্ধীর ইতালীয় পরিবার ছাড়াও ওই জাহাজ এবং বিমানবাহিনীর হেলিকপ্টার রাজীবের অভিনেতা–বন্ধু অমিতাভ বচ্চন ও তাঁর পরিবারও ব্যবহার করেছিলেন বলে মোদির অভিযোগ। তাঁর অভিযোগ, নেহরু–ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকেই এই পারিবারিক ছুটি কাটানোর প্রথা চালু রয়েছে।

এত বছর পর শুধু এই অভিযোগই নয়, ইন্দিরা গান্ধীর হত্যার পর দিল্লির শিখ দাঙ্গার জন্যও তিনি সরাসরি রাজীব গান্ধীকে অপরাধী সাব্যস্ত করেছেন।

কংগ্রেস চুপ করে বসে নেই। নীরব নন তৎকালীন নৌপ্রধান লক্ষ্মীনারায়ণ রামদাসও। চন্দ্র শেখরের আমলে রাজীব নিহত হলেও দায়ী করা হচ্ছে বিজেপি সরকারকেই। কংগ্রেস নেতা আহমেদ প্যাটেল বিজেপিকে একহাত নিয়ে বলেছেন, রাজীব গান্ধীর মৃত্যুর জন্য বিজেপিই দায়ী। বিজেপির সমর্থনেই সরকার গড়েছিলেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং। প্রধানমন্ত্রী হয়ে সেই বিশ্বনাথ প্রতাপই রাজীবের নিরাপত্তা কমিয়ে দিয়েছিলেন। বারবার বলা সত্ত্বেও রাজীবকে বাড়তি নিরাপত্তা দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংয়ের সরকার। একজন মাত্র নিরাপত্তা কর্মকর্তার দায়িত্ব ছিল রাজীবকে রক্ষার, গোয়েন্দাদের কাজের তেমন কোনো অভিজ্ঞতা যাঁর ছিল না। প্যাটেল টুইটে বলেন, বিজেপির বিদ্বেষ ও ঘৃণার রাজনীতিই রাজীবের প্রাণ কেড়ে নিয়েছিল।

মোদির অভিযোগ সরাসরি অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছেন সেই সময়কার নৌপ্রধান অ্যাডমিরাল লক্ষ্মীনারায়ণ রামদাস। গতকাল বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগ খণ্ডন করে তিনি বলেন, রাজীব ত্রিবান্দ্রমে (তিরুবনন্তপুরম) সরকারি কাজে ছিলেন। দ্বীপ উন্নয়ন পর্ষদের বৈঠকে যোগ দিতে লাক্ষাদ্বীপে গিয়েছিলেন ‘আইএনএস বিরাট’–এ চেপে। স্ত্রী সোনিয়া ছাড়া তাঁর সঙ্গে ওই রণপোতে আর কেউ ছিলেন না। কোনো বিদেশি নাগরিকও নন। একই কথা বলেছেন সেই সময় ‘আইএনএস বিরাট’–এর দায়িত্বে থাকা ভাইস অ্যাডমিরাল বিনোদ পাসরিচা। তিনি বলেছেন, কোনো প্রটোকল ভাঙা হয়নি। বেআইনিও কিছু করা হয়নি।

হঠাৎ কেন এভাবে কংগ্রেসকে আক্রমণ শুরু করলেন মোদি? তাহলে কি কংগ্রেসের মধ্যে তিনি বিপদের কোনো সংকেত পেতে শুরু করেছেন? কংগ্রেস কি তাঁর দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথে কাঁটা বিছোচ্ছে? প্রিয়াঙ্কা গান্ধী কয়েক দিন আগেই বলেছিলেন, উত্তর প্রদেশে তাঁরা এমনভাবে প্রার্থী দিয়েছেন, যাতে বিজেপির ভোট কাটা যায়। তবে কি প্রিয়াঙ্কার ওই মন্তব্য সত্য হতে চলেছে? তাই কি মোদি অসহিষ্ণু হয়ে পড়েছেন? সে জন্যই কি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে আক্রমণ?

রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা, কংগ্রেসশাসিত তিন রাজ্যে বিজেপি গতবারের মতো ভালো ফল করতে পারছে না। উত্তর প্রদেশেও কংগ্রেস বিজেপির কাছে বাড়তি ‘বিড়ম্বনা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। মোদির রাগের এটা একটা কারণ। দ্বিতীয় কারণ, রাফাল–সংক্রান্ত অস্বস্তি। রাফালকে কেন্দ্র করে প্রধানমন্ত্রীর ‘সততাকে’ কংগ্রেস প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে। মোদির ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তাই এইভাবে।

অন্য একটা ব্যাখ্যাও রয়েছে। ষষ্ঠ পর্বে রয়েছে দিল্লির ৭ ও হরিয়ানার ১০ আসনে ভোট। শেষ পর্বে রয়েছে পাঞ্জাবের ১৩টি কেন্দ্র। তিন রাজ্যেই শিখ ভোটার প্রচুর। এবং কংগ্রেসও একটা বড় শক্তি। ১৯৮৪ সালের দাঙ্গা এবং রাজীবকে নানাভাবে আক্রমণ করে মোদি এই ৩০ আসনে কংগ্রেসকে কোণঠাসা করতে চাইছেন। সাত পর্বের এই নির্বাচনে শেষ পর্বের ভোট ১৯ মে। ফল জানা যাবে ২৩ মে।

পরিহাসের বিষয় এটাই, পাঁচ বছর আগে কংগ্রেসমুক্ত ভারত গড়ার ডাক দিলেও সেই কংগ্রেসের রাজনৈতিক গুরুত্বকে অস্বীকার করতে পারছেন না প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। শেষ বেলায় কংগ্রেসই তাই তাঁর আক্রমণের মূল লক্ষ্য।