প্রচ্ছদ হেড লাইন রিফাত হত্যা: মিন্নিসহ ৬ জনের ফাঁসির আদেশ,বেকসুর খালাস চারজন

রিফাত হত্যা: মিন্নিসহ ৬ জনের ফাঁসির আদেশ,বেকসুর খালাস চারজন

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

বহুল আলোচিত বরগুনার রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই মামলায় চারজনকে খালাস প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত।

বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আসাদুজ্জামান মিয়া এ রায় ঘোষণা করেন। এসময় মিন্নিসহ ৯ আসামি আদালতে উপস্থিত ছিলেন। মামলার ৬ নম্বর আসামি মুছা বন্ড পলাতক রয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন, রাকিবুল হাসান রিফাত ফরাজি (২৩), আল কাইউম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯), আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি (১৯)। খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯), ও কামরুল ইসলাম সাইমুন (২১)।

গত ১৬ সেপ্টেম্বর এ মামলার যুক্তিতর্ক শেষ হলে রায় ঘোষণার জন্য ৩০ সেপ্টেম্বর তারিখ ধার্য করেন আদালত। ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে প্রকাশ্যে কুপিয়ে জখম করা হয় রিফাত শরীফকে। ওই দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। এরপর রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বাদী হয়ে বরগুনা থানায় ১২জনের নাম উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।

এ মামলায় রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দীকা মিন্নিকে প্রধান সাক্ষি রাখা হয়। এরপর ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে বরগুনার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুই ভাগে বিভক্ত অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয় পুলিশ। এ মামলায় প্রাপ্তবয়স্ক ১০ ও কিশোর ১৪ জনের আলাদা বিচারিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের অভিযোগপত্রে মিন্নিকে ৭ নম্বর আসামি রাখা হয়। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি মামলার চার্জগঠন হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর মামলাটির যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের তারিখে ঘোষণা করা হয়।

বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপনসহ ৪৩ কার্যদিবসের মধ্যে বিচারিক কার্যক্রম শেষ করে। বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুর পৌনে ২টার দিকে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান।

বাদির প্রতক্রিয়া: রায় ঘোষণার পর রিফাতের বাবা দুলাল শরীফ বলেন, এক বছর ধরে আমাদের পরিবারের সদস্যরা কাঁদছি। আমাদের নির্ঘুম দিন কাটছে। ওই কান্না আর আজকের কান্নার মধ্যে অনেক তফাত। ১৫টা মাস এই দিনটার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। রায়ে রিফাতের আত্মা শান্তি পাবে।

তিনি বলেন, আমরা সুবিচার পেয়েছি। তবে রায় কার্যকর না হওয়া পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছি না। কাঙ্ক্ষিত রায় পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান দুলাল শরীফ।

মিন্নির বাবার প্রতক্রিয়া: রায়ের পর প্রতিক্রিয়ার আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নির বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোর বলেন, এই রায়কে আমি প্রত্যাখ্যান করি। আমার মিন্নির প্রতি অবিচার করা হয়েছে। সারাবিশ্ব দেখেছে মিন্নি তার স্বামী রিফাতকে বাঁচানোর জন্য জীবন বাজি রেখে অস্ত্রের মুখে ঝাপিয়ে পড়েছে। আমি উচ্চাদালাতে ন্যায় বিচারের জন্য যাব।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য: রাষ্ট্রপক্ষ রিফাত শরীফ হত্যা মামলা পরিচালনার জন্য তিনজন আইনজীবী নিয়োজিত করেছিলেন। এদের মধ্যে একজন অ্যাডভোকেট ভূবন চন্দ্র দাস বলেন, আমরা রায়ের সন্তষ্ট। বরগুনার জন্য এই রায় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা মনে করি এ রায়ের মধ্য দিয়ে বরগুনা কলঙ্কমুক্ত হয়েছে।

একই বক্তব্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মজিবুল হক কিসলু ও মোস্তাফিজুর রহমানেরও। তারা বলেন, মিন্নি এ ঘটনার মাষ্টারমাইন্ড আদালতকে আমরা তথ্য উপাত্ত ও সাক্ষি প্রমাণে প্রমাণ করতে পেরেছি।

মিন্নির পক্ষের আইনজীবীর বক্তব্য: মিন্নির পক্ষে মামলা পরিচালনা করেছেন আইনজীবী মাহবুবুল বারি আসলাম। তিনি বলেন, মিন্নির বিষয়ে আমরা শিঘ্রই উচ্চাদালতের স্মরণাপন্ন হব। আমরা মনে করি উচ্চাদালতে মিন্নি খালাস পেয়ে মুক্ত হতে পারবে।

রিফাতের মা ও বোনের প্রতিক্রিয়া: মিন্নিসহ ৬আসামীর ফাঁসির রায়ের খবর শুনে রিফাতের মা ডেইজী বেগম বলেন, আমার রিফাতকে ওরা নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করেছে। ওদের ফাঁসি কার্যকর হলেও আমি ও আমার ছেলের বিদেহি আত্মা শান্তি পাবে। বোন ইসরাত জাহান মৌ বলেন, ভাইয়া মারা যাবার পর আমরা একদিনও ঘুমাতে পারিনি। এ রায় কার্যকর হওয়ার পর আমি স্বস্তি পাবো।

আদালতের পর্যবেক্ষণ: ২০০ পৃষ্ঠার রায় ঘোষণা করেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোঃ আসাদুজজ্জামান। রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন মিন্নি। তারই পরিকল্পনায় রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এ মামলার রায় ঘোষণা করেন বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আছাদুজ্জামান। রায়ে পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, রিফাত হত্যা মামলার আসামিদের নির্মম বর্বরতা ও নির্মমতা মধ্যযুগীয় কায়দায়কেও হার মানিয়েছে। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে তাদের অনুসরণ করে অন্য যুবকরাও ধ্বংসের পথে যাবে। এসব আসামি সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য।

রায় ঘোষণার সময় বিচারক বলেন, পাঁচজনের সহযোগী হিসেবে রিফাত শরীফ হত্যায় অংশ নিয়েছেন স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। একই সঙ্গে তারা ছয়জন রিফাতের মৃত্যু নিশ্চিত করেছেন। এজন্য কলেজগেটের সামনে সময়ক্ষেপণ করেন মিন্নি। রিফাতকে যখন মারার জন্য আসামিরা নিয়ে যাচ্ছিল তখন স্বাভাবিক ছিলেন মিন্নি। এতেই প্রমাণিত হয়, মিন্নি হত্যা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। তারই পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এজন্য তাকেও ফাঁসি দেয়া হয়েছে।

দন্ড নিয়েও হাস্যোজ্জল আসামীরা: বরগুনায় রিফাত হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী রায়ের পর হাসতে হাসতে আদালত থেকে বেরিয়ে প্রিজনভ্যানে ওঠেন।

এ সময় তিনি বলেন, ‘আমরা সব আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিলাম। অতীতে যা হয়েছে তা আল্লাহ করেছেন আর ভবিষ্যতে যা হবে সেটাও আল্লাহই করবেন।’

বুধবার দুপুর ২টা ৫৫ মিনিটে আদালত থেকে আসামিদের কারাগারে নেয়ার সময় প্রিজনভ্যানে ওঠার মুহূর্তে এসব কথা বলেন রিফাত ফরাজি। তবে আশপাশের শব্দের কারণে তার বাকি বক্তব্য স্পষ্ট শোনা যায়নি। এ সময় শুধু আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন ছাড়া বাকি সাজাপ্রাপ্তরা স্বাভাবিক ছিলেন।

কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা: সকাল থেকেই আদালত এলাকায় রায় শোনার জন্য অপেক্ষমান ছিলেন আসামীদের স্বজনরা। রায় ঘোষণার পরপরই দন্ডপ্রাপ্ত আসামীদের আদালত এলাকায় কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা যায়। বিশেষ করে বেশ কয়েকজন আসামীর নারী স্বজনরা এসময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

বাড়ি ফেরা হয়নি, ফাঁসির দন্ড নিয়ে জেলহাজতে মিন্নি: অবশেষে ফাঁসির দণ্ড মাথায় নিয়ে আদালত থেকে কারাগারে গেলেন জামিনে থাকা বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার সাত নম্বর আসামি স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। রিফাত হত্যা মামলায় তাঁকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দিয়েছে আদালত। ফাঁসির আদেশের পরই মিন্নিকে হেফাজতে নেয় পুলিশ। একই সঙ্গে মিন্নিকে গ্রেফতার দেখানো হয়। এরপর বেলা তিনটার দিকে আদালত থেকে বের করে আলাদা গাড়িতে মিন্নিকে বরগুনা জেলা কারাগারে নেয়া হয়।

নয়ন বন্ডের মায়ের প্রতিক্রিয়া: রিফাত শরীফ হত্যার মামলায় মিন্নিসহ ৬ আসামীর ফাঁসির খবর শুনে ‘ আলহামদুল্লিাহ’, আমি খুশি হয়েছি। এই রায় কার্যকর হলে আমি মিলাদ দেব। বলেছেন নিহত নয়ন বন্ডের মা সাহিদা বেদম।

তিনি বলেন, মিন্নির কারণে আমার ছেলের এমন পরিণতি হয়েছে। আমার ছেলে ভালো হয়ে গেছিল। মিন্নি রিফাতকে বিয়ে করার পর নয়ন ক্ষুদ্ধ হয়। আমি মিন্নিকে কখনো ক্ষমা করবোনা।

তিনি বলেন, মিন্নির এমন বিচারে সবাই সচেতন হবে। যাতে করে নতুন করে মিন্নির মত কেউ জন্ম না নেয়। ওর কারণে কতগুলা পরিবার ধ্বংস হয়ে গেল। আমার ছেলের পরিণতি হল নির্বিচারে মৃত্যু। আমার ছেলে অন্যায় করলেও ন্যায় বিচারের দাবি রাখি আমরা। কিন্ত সে সুযোগ দেয়া হয়নি, আমি আমার ছেলেকে নির্বিচারে হত্যার বিচার চাই।

গত ২ জুলাই ২০১৯ তারিখ ভোরে পুলিশের সাথে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় রিফাত শরীফ হত্যা মামলার প্রধান আসামী ০০৭ বন্ড গ্রুপের প্রধান নয়ন বন্ড।

বরগুনা কলঙ্কমুক্ত হয়েছে: রায়ের পর প্রতিক্রিয়ায় বরগুনার সূধিসমাজ ও থেকে শুরু করে আপামর জনসাধারণ সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। রায়কে কেন্দ্র করে আদালত এলাকায় সকাল থেকেই উৎসুক মানুষদের ভিড় ছিল। ভিড় সামলাতে একপ্রকার হিমশিম খেতে হয়েছে আইন-শৃঙ্খরা রক্ষাকারী বাহীনিকে। কেউ কেউ কাজ ফেলেও রায় শোনার জন্য অধির আগ্রহে আদালত এলাকায় দিনভর অবস্থান নিয়েছিলেন। রায়ের সাধারণ মানুষদের সন্তোষ প্রকাশ করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়েছে এমন মন্তব্য করতে শোনা যায়। এ রায় কার্যকর হলে বরগুনাসহ দেশব্যাপি কেউ এমন অপরাধ করার সাহস করবেনা বলেও অনেকে মন্তব্য করেণ।

উল্লেখ্য, ২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত লোকের ভিড়ে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। পরে রিফাতকে কুপিয়ে হত্যার একটি ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও পাঁচ-ছয়জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দু’ভাগে বিভক্ত করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।

১ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ আদালত। এরপর ৮ জানুয়ারি থেকে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন আদালত। এ মামলায় মোট ৭৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর এ মামলার দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের শুনানি শেষে বরগুনার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মো. আসাদুজ্জামান রায়ের জন্য বুধবার (৩০ সেপ্টেম্বর) দিন ধার্য করেন।