প্রচ্ছদ ধর্ম রমজানে শুধু খাবার নয় মন্দ থেকেও বিরত থাকতে হবে

রমজানে শুধু খাবার নয় মন্দ থেকেও বিরত থাকতে হবে

রহমত, মাগফিরাত ও নাজাতের মাস মাহে রমজান। বিশ্বের সকল মুসলিম প্রতি বছর এর জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় থাকেন। মাহে রমজান, আস্-সালাম, স্বাগতম হে রমজান’ এসব বলে মুসলমানরা বরণ করে নেন রমজানকে। রমজান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অত্যন্ত সুপরিচিত এক নাম। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

হযরত আদম (আ.), নূহ (আ.), মূসা (আ.), দাউদ (আ.)সহ সমস্ত নবীর উপর এ মাসে রোজা ফরজ ছিল। এটা নতুন কোন বিষয় নয়। বাইবেলেও রোজা রাখার নির্দেশ রয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে এ মাস সকল জাতির জন্য হাদিয়াস্বরূপ। এতে রয়েছে আনন্দের বার্তা, তাকওয়া অর্জনের উত্তম পন্থা, নেকীর প্রেরণা, পরের মঙ্গল কামনা, দান খয়রাত, তিলাওয়াত, তারাবিহ্, সাহরী, ই’তিকাফ, শবে কদর, ইফতার, দোয়া অগণিত ও অফুরন্ত নেয়ামতরাশি এবং কঠিন সাধনার মাধ্যমে ইসলাহে নাফস বা আত্মসংশোধনমূলক শিক্ষা।

কুরআনুল কারীমে বলা হয়েছে, যে তার নাফসকে সংশোধন করতে পেরেছে সে সফলকাম হয়েছে। হাদীসে এসেছে, তোমাদের শরীরের ভিতরে একটা টুকরা রয়েছে। যখন ওই টুকরাটা ভাল থাকবে, তখন পুরো শরীর বা মানুষটাই ভাল থাকবে। যখন ওই টুকরাটা মন্দ হয়ে যাবে, তখন পুরো মানুষটাই মন্দ হয়ে যায়। জেনে রাখ, ইহা হলো ক্বালব। এগুলো সংশোধন করার একটা উপায় হলো, রোজা রাখা।

প্র্যাক্টিকেল ক্লাস বা বিশেষ ট্রেনিং নেয়ার মাধ্যমে ওই ক্বালব, নাফস বা আত্মাকে সংশোধন করতে হবে। এজন্যে বিশেষ করে আল্লাহ পাক যে সময় বা তারিখ দান করেছেন এর নাম মাহে রমজান। রমজানের প্রত্যেক সুবহি সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সকল বালেগ নারী-পুরুষ কোন কিছু না খেয়ে কোন প্রকার অশ্লীল বা মন্দ কাজে নিজেকে না জড়িয়ে মাওলাকে খুশি করার উদ্দেশ্যে রোজা রাখার নিয়্যাতে সারা দিনমান উপবাস থাকাকে সাওম বলে। সাওমের বহুবচন হলো সিয়াম। এটা একটা সাধনার নাম। বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে প্রকৃত রোজা রাখতে হলে বিশেষ সাধনা বা তপস্যা ব্যতিত আদৌ সম্ভব নয়। কারণ, যেদিকে তাকানো যায়, সেদিকেই অশ্লীল বেহায়াপনা, অনিয়ম আল গুনাহ। গুনাহ ভাইরাস বা ঈমানের জন্য ক্যানসারস্বরূপ। যা রোজাকে আক্রমণ করে এর এ্যাকশান নষ্ট করে দেয়। এসব থেকে বাঁচতে হলে সিয়াম সাধনার বিকল্প নেই।

এর প্রকৃত অর্থ হৃদয়াঙ্গম করতে হবে। খানা পিনা থেকে পেটকে বিরত রাখা পাশাপাশি মন্দ দেখা থেকে চোখকে, মন্দ শোনা থেকে কানকে, মন্দ চিন্তা থেকে মাথাকে এভাবে প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে শুধু রমজান মাসে নয়, সারা বছরঅবধি মুমিনকে মন্দ থেকে বিরত রাখার আমরণ সাধনা করে যেতে হবে। তাহলেই মাহে রমজানের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য উপলব্ধি বা এর মধ্যে থাকা ধনভান্ডার উদ্ধার করতে পারবে।

রমজানের ফজিলত সম্বন্ধে হুজুর (সা.) অনেক বাণী রেখে গেছেন। এক হাদীসে কুদসীতে নাবী কারীম (সা.) বলেন, আদম সন্তানের প্রত্যেক নেক আমলের সাওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশ গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়। আল্লাহ তা’য়ালা বলেন, কিন্তু রোজা ব্যতিত। কেননা, এটা আমার জন্য। আর এর পুরস্কার আমিই দিব। রোজার মাসকে শাহরুল্লাহ বা আল্লাহর মাস বলা হয়। অতএব, বুঝাই যাচ্ছে যে, এর গুরুত্ব কতটুকু।

তারাবীহের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে হুজুর (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি তারাবীহের বিশ রাকায়াত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তাকে প্রতি সিজদার পরিবর্তে ১ হাজার ৫শ নেকী দান করবেন। শুধু তাই নয়, ওই ব্যক্তির জন্য বেহেশতের মধ্যে লাল ইয়াকুত পাথর দিয়ে এমন একটি বাড়ি তৈরি করে দিবেন, যাতে ৬০ হাজার দরজা থাকবে এবং প্রত্যেক দরজায় লাল ইয়াকুতমন্ডিত একটি করে স্বর্ণের প্রাসাদ থাকবে। আরো যেসব হাদীসে হুজুর (সা.) বলে গেছেন শুনলে এসব নিয়ামতের প্রতি লোভ হয়। কিন্তু তা হাদসিলের জন্য আমল করতে যেন লোভ হয় না। এ রোগ থেকে আল্লাহ পাক আমাদেরকে সুস্থ্যতা দান করুন।

আজ এ রমজানে বিধর্মীদের কথা বলে হোটেল খোলা রেখে পর্দার আড়ালে যা হচ্ছে তা ঠিক নয়। মানুষ মুখে যা বলছে তা করছে না। এই যে অমিল, এর কারণ কি? প্রকৃতপক্ষে যদি যথাযথভাবে সিয়াম সাধনা করা হতো তবে এমনটি হবার কথা নয়। কেন হচ্ছে? শিক্ষক, অফিসার বা যে কোন কর্মচারী তার পুরো ডিউটি না করে পুরো বেতন নিয়ে যাচ্ছেন, মাদরাসার সুপারের কাছে সুন্নাত পর্যুদস্ত হচ্ছে, দাঁড়ির উপর আযাব চলছে। আমল ঠিক নেই। তাহলে স্কুলের হেড মাস্টার কি করবেন? আর তাদের ছাত্রই বা কেমন হবে? কিছু সংখ্যক টাইটেল পাস প্রিন্সিপাল হুজুরদের নামাজ দেখে ভ্রাম্যমান স্কুলের ছাত্র অর্থাৎ তাবলীগ পাস অশিক্ষিত হুজুরদের কেবল হাসি পায়। দাওরা মাদরাসার মুহতামিম হয়েও রুকু থেকে সোজা না হয়ে সিজদায় চলে যায়। বড় মসজিদে ইমামতি করছেন কিন্তু ক্বিরাত সহীহ না।

দোয়ার আগে পরে দরুদ শরীফ পড়তে শোনা যায় না। পড়লেও দরুদ শুদ্ধ হয় না। এমন কেন হয়? এগুলো কি তাকওয়া বা রমজানের শিক্ষার পরিপন্থী নয়?  রমজানের প্রকৃত শিক্ষা থেকে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি বলেই এসব হচ্ছে বলে আমার মনে হয়। আল্লাহ সব দেখেন, একথা মুখে স্বীকার করলেও কার্যত: মানা হচ্ছে না। রমজানের এ শিক্ষা যিনি নিয়েছেন তিনি কিভাবে এসব মন্দ কাজে জড়িত হন? অশিক্ষিত লোকেরা চেয়ে থাকেন শিক্ষিত বা আলিমের দিকে। কিন্তু তাদের এসব ভুল হলে কেমনে চলে? ছাত্রকে বলা হয় সিগারেট এনে দিতে। ডাক্তার চেম্বারে বসে ধুমপান করেন। টাখনুর নিচে প্যান্ট পরেন। এদের নিকট থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি আদর্শ শিখবেন? এগুলো রমজানের শিক্ষা নয়। আসলে আমরা রমজানের রোজা রাখছি ঠিকই কিন্তু এ থেকে শিক্ষা নিচ্ছি না।

বলা হয়, এ মাস আসলে মুসলিম পরিবারগুলোতে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। কিন্তু কেন? এর উত্তর হয়তো অনেকেরই জানা নেই। তবে মূল কারণ হালো, রমজান এমন এক মাস যা রোজাদারের গুনাহকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। এর প্রভাবে মালিকরা শ্রমিকদের কাজের চাপ কমিয়ে দেন।
মসজিদগুলোতে মুসল্লি বেড়ে যায়। ইফতারের সময় বিরাট আনন্দঘন পরিবেশের অবতারণা হয়। সর্বোপরি, গুনাহ ছারখার হয়ে যাওয়ার কারণে ওই রোজাদার ব্যক্তি ওলীতে পরিণত হয়ে যান। আর যে ওলী হয়ে গেল, তার সব হয়ে গেল। আমার মনে হয়, এটাও একটা কারণ। যাক, যার উসীলায় আমরা এসব পাচ্ছি তাকে নিশ্চয়ই কদর করা উচিৎ, তার দাবি পূরণ করা উচিৎ। করব, ইনশা-আল্লাহ। রমজানের দাবি পূরণ করতে হবে। মানুষ বলে, কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। মূলত: কিছু দেয়ার মাধ্যমেই কিছু পাওয়ার অধিকার সৃষ্টি হয়। কাজেই আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে রমজানকে মূল্যায়ণ করব। রমজানের হক আদায় করব আমাদেরই স্বার্থে। আল্লাহ পাক আমাদের সবাইকে তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: খতীব, দিউ বায়তুস সালাম জামে মসজিদ, কলেজ রোড, ফুলপুর, ময়মনসিংহ।