প্রচ্ছদ সারাদেশ ঢাকা বিভাগ বৃক্ষপ্রেমী এক শাহজাহানের গল্প

বৃক্ষপ্রেমী এক শাহজাহানের গল্প

মানুষের কত ধরনেরই না শখ থাকে। ঘুরে বেড়ানো, গান শোনা, দেশ থেকে দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো, পাহাড়-পর্বতের চূড়ায় ওঠা আরও কত কী?

কিন্তু মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি গ্রামের শাহজাহান বিশ্বাসের শখ শুধুই গাছ লাগানো। গাছের সঙ্গেই যেন তার সব শখ্যতা, গাছই যেন সংসার এবং গাছের সঙ্গেই তার মিতালি। তিনি যেন গাছকেই বেশি ভালোবাসেন। আর তাই এলাকায় তিনি ‘বৃক্ষপ্রেমিক শাহজাহান’ নামেই পরিচিত।

গত ৩৬ বছরে এই গ্রামে তিনি নিজের খরচে ৬০-৭০ হাজার গাছ রোপণ করেছেন।

সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ছায়া-সুনিবিড় নিভৃত পাখি ডাকা গ্রাম মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের কৌড়ি গ্রাম। গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই সুশৃঙ্খল বৃক্ষরাজি। গাঁওয়ের আঁকাবাঁকা পথের দুই পাশে বনজ, ফলদ ও ঔষধি বৃক্ষে পূর্ণ সবুজের সমাহার। যেন শিল্পীর পটে আঁকা এক ছবি।

এমন নজরকাড়া হাজারও বৃক্ষের সাজে সজ্জিত দৃশ্য। নয়নাভিরাম এই সবুজ বিপ্লবের এমন সাফল্য গাঁথার কারিগর বৃক্ষপ্রেমিক শাহজাহান বিশ্বাস। ৬০ বছর বয়সী সাজাহান বিশ্বাস এখনও চিরকুমার।

ব্যক্তিজীবনে ঘর-সংসার না বাঁধলেও গাছের সঙ্গে মিতালি করায় প্রতিটি গাছকেই ভালোবাসেন আপন মমতায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত গাছ লাগিয়ে যেতে চান এই পরিবেশবন্ধু।

সরেজমিন গিয়ে মনোমুগ্ধকর সবুজের বেষ্টনী দেখতে গিয়ে কথা হয় বৃক্ষপ্রেমী সাজাহান বিশ্বাসের সঙ্গে।

তিনি জানান, এইচএসসি পাসের পর ১৯৭৬ সালে বিদেশে চলে যান। বিভিন্ন দেশের বনাঞ্চল আর বৃক্ষরোপণ দেখে উদ্বুদ্ধ হন এবং বছর পাঁচেক পর দেশে ফিরে গড়ে তোলেন নার্সারি। সেখানে চারা উৎপাদন করে রাস্তার দুপাশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিসের ক্যাম্পাসে নিজের খরচে গাছ লাগাতে শুরু করেন শাহজাহান মিয়া। তার এমন মহৎ উদ্যোগ আর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে হরিরামপুর উপজেলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বেড়ে গেছে অনেক।

নিজ হাতে এক জীবনে ৬০-৭০ হাজার বৃক্ষরোপণ এমন ইতিহাস সৃষ্টিকারী বৃক্ষপ্রেমিক শাহজাহান বিশ্বাস বলেন, উদ্ভিদ আর প্রাণী এমনভাবে জড়িত, ওরা ছাড়া আমরা নিরুপায়; আমরা ছাড়া ওরা নিরুপায়। মানুষ তো প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যে পরিমাণ উদ্ভিত প্রয়োজন, সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। তা হলে তো এই দেশ একসময় মরুভূমি হয়ে যাবে।

তিনি আরও বলেন, আমি যেভাবে গাছ রোপণ করছি, বাংলাদেশের প্রত্যেকটি শাহজাহান যদি এভাবে গাছ রোপণ করত, তা হলে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হয়ে যেতাম। সোনার বাংলা চাইতে গেলে, ডিজিটাল, সমৃদ্ধশালী দেশ করতে গেলে তো ইন্ডাস্ট্রিজ করতে হবে।

শাহজাহান বিশ্বাস বলেন, গাছও একটি ইন্ডাস্টিজ। সারা দেশে যদি এভাবে পরিকল্পনা অনুযায়ী যদি গাছ রোপণ করা যায়, তা হলে কোনো অভাব থাকবে না। এ দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্য কখনও নষ্ট হতো না। আমি যখন আমার গ্রামের মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে যাই, তখন দেখি গাছের ছায়ার নিচে বসে অনেক কৃষক বিশ্রাম নিচ্ছে, তখন মনে হয় আমি সফল। আমার নতুন প্রজন্মের প্রতি একটিই আহ্বান– সোনার বাংলাদেশ গড়তে গেলে সবুজের বাংলাদেশ গড়তে হবে।

এ প্রসঙ্গে স্থানীয় এমএ রউফ ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক ডিএম নাসিম জানান, সাজাহান বিশ্বাসের কারণে বদলে গেছে গোটা উপজেলার প্রকৃতির চিত্র। তার দেখাদেখি আশপাশের মানুষও উদ্বুদ্ধ হয়ে গাছ লাগাচ্ছেন। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি গ্রাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই গ্রামের হাজার হাজার বৃক্ষের শরীরে একজন মানুষের নাম তিনি শাহজাহান বিশ্বাস।

প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য গাছ রোপণ করতে হয়, জীবনের নানা প্রয়োজনে, নানা সংকটে এই গাছই যে কতভাবে উপকারে আসে মানুষের তা বোঝাতে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে পরামর্শ দিচ্ছেন বৃক্ষপ্রেমী প্রেমিক শাহজাহান।

কৌড়ি এলাকার গ্রামজুড়ে রাস্তার দুপাশে গাছ লাগানোর কারণে মানিকগঞ্জসহ আশপাশের জেলার মানুষের কাছে এই স্থানটি দর্শনীয় হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

শাহজাহান বিশ্বাসের এমন উদ্যোগের প্রশংসা করল স্থানীয় বন বিভাগ। তারা বলছে, বৃক্ষরোপণে তাকে নানাবিধ পরামর্শ দেয়া হয়। শাহজাহান মিয়াকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়ে হরিরামপুর উপজেলার কৌড়ি গ্রামের আশপাশের লোকজনও কয়েক লাখ গাছ লাগিয়েছেন।

কৌড়ি গ্রামের তাহেজ মিয়া বলেন, রাস্তার পাড়ে আমার ১১ শতাংশ জায়গা আছে। আর সেই রাস্তার পাশে শাহজাহান ভাই ১০ বছর আগে ১৪টি গাছ রোপণ করেছিলেন। গত বছর সেই ১৪টি গাছ বিক্রয় করে আমি একটি জায়গা ক্রয় করে বাড়ি করেছি। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আমার মতো আরও অনেকে শাহজাহান ভাইয়ের রোপণ করা গাছ বিক্রয় করে নিজেদের অনেক প্রয়োজন মিটিয়েছেন। সূত্র : যুগান্তর