প্রচ্ছদ অর্থনীতি বিশ্বমন্দা ও করোনায় এডিপিতে বড় কাটছাঁট

বিশ্বমন্দা ও করোনায় এডিপিতে বড় কাটছাঁট

বিশ্ব মন্দাভাবে আমদানি-রফতানিতে পতন এবং বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতি একটা শঙ্কার মধ্যে রয়েছে। রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রায় বড় ধরনের ঘাটতির কারণে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে অর্থায়ন নিয়ে শঙ্কা বিরাজ করছে।

এ পরিস্থিতিতে প্রতিবারের মতো এবার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কাটছাঁট করা হচ্ছে। ৪.৮৩ শতাংশ কমানোর পরও সংশোধিত এডিপি বাস্তবায়নে অর্থের জোগান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সচিবরা। আরএডিপিতে অগ্রাধিকার থাকলেও পরিবহন, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্য ও কৃষি খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে ভৌত, বিজ্ঞান, শিক্ষা ও পল্লী উন্নয়নে বরাদ্দ।

অর্থায়ন নিয়ে শঙ্কার মধ্যেও বরাদ্দবিহীন অননুমোদিত ৭৭১টি নতুন প্রকল্পের ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে এডিপি। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভায় এই আকার অনুমোদন দিয়ে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রস্তাব যাচ্ছে বলে পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে।

পরিকল্পনা কমিশনের প্রস্তাবনা থেকে জানা গেছে, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরের এডিপির আকার ছোট করা হচ্ছে। মূল আকার দুই লাখ দুই হাজার ৭২১ কোটি টাকা থেকে ৯ হাজার ৮০০ কোটি টাকা কমিয়ে এক লাখ ৯২ হাজার ৯২১ কোটি টাকায় করা সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিকল্পনা কমিশনের বর্ধিত সভা। এই আকার গত অর্থবছরে আরএডিপির চেয়ে ১৫ দশমিক ৫২ শতাংশ বেশি। আরএডিপিতে অর্থায়ন হবে স্থানীয় মুদ্রায় এক লাখ ৩০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা বা ৬৭.৮৬ শতাংশ এবং প্রকল্প সাহায্য ৬২ হাজার কোটি টাকা বা ৩২.১৪ শতাংশ।

তবে কার্যক্রম বিভাগের দেয়া কল নোটিশ থেকে এই আকার ১৭ হাজার ৫৭৩ কোটি ৯৫ লাখ টাকা কম। পদ্মা বহুমুখী সেতুর কারণে বরাদ্দের দিক দিয়ে মূল এডিপির মতোই শীর্ষে আছে পরিবহন খাত। তবে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে প্রায় দেড় শতাংশ, এখন ২৪.৬৫ শতাংশ। দ্বিতীয় শীষে থাকা বিদ্যুৎ খাতের বরাদ্দও কমিয়ে তাকে তৃতীয় অবস্থানে রাখা হয়েছে। তার বরাদ্দ দশমিক ৫২ শতাংশ কমিয়ে ১২.৩১ শতাংশ করা হয়েছে। আরএডিপিতে ভৌত পরিকল্পনা, পানি সরবরাহ ও গৃহায়ন খাতের বরাদ্দ ১.৭৫ শতাংশ বাড়িয়ে ১৩.৭৫ শতাংশ করা হয়েছে।

শিক্ষা ও ধর্মে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে দশমিক ০৪ শতাংশ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ দশমিক ০৬ শতাংশ বাড়িয়ে ৮.৭১ শতাংশ এবং পল্লী প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা ও কৃষি খাতে বরাদ্দ কমিয়ে দেয়া হয়েছে।

কমিশন সূত্রের তথ্য ও খসড়া সংশোধিত এডিপি অনুযায়ী, মূল এডিপিতে প্রকল্প ছিল এক হাজার ৪৭৫টি (স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বাদে)। সেখান থেকে ২৬৯টি বৃদ্ধি পেয়ে আরএডিপিতে সংখ্যা দাঁড়াচ্ছে এক হাজার ৭৪৪টি। তবে এর মধ্যে নতুনভাবে অনুমোদিত প্রকল্প রয়েছে ২৪৬টি এবং মূল এডিপিতে অন্তর্ভুক্ত নেই এমন ২৩টি প্রকল্প রয়েছে। বৈদেশিক সাহায্য প্রাপ্তির সুবিধার জন্য যুক্ত করা হচ্ছে ১৯০টি উন্নয়ন প্রকল্পের তালিকা; যা মূল এডিপিতে ছিল ২৪২টি।

এ ছাড়া পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) তালিকায় প্রকল্প হিসেবে রাখা হচ্ছে ২২টি উন্নয়ন প্রকল্প; যা মূল এডিপিতে ছিল ৬২টি। বরাদ্দহীনভাবে অননুমোদিত নতুন প্রকল্পের সংখ্যা রয়েছে ৭৭১টি। মূল এডিপিতে এই তালিকায় ছিল এক হাজার ৪৫টি প্রকল্প। সেই সাথে স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার নিজস্ব অর্থায়নে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্প রাখা হচ্ছে ১০৩টি; যা মূল এডিপিতে ছিল ৮৯টি।

অন্য দিকে সংশোধিত এডিপিতে কমানো হয়েছে প্রকল্প সমাপ্তির লক্ষ্যমাত্রা। চলতি অর্থবছরের শুরুতেই ৩৫৫টি প্রকল্প সমাপ্ত করার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্য বিনিয়োগ প্রকল্প ছিল ৩৪১টি এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্প ১৪টি। কিন্তু বাস্তবায়নে শ্লথ গতির কারণে সংশোধিত এডিপিতে এই লক্ষ্যমাত্রা ৩১৪টিতে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এর মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প ৩১২টি এবং কারিগরি সহায়তা প্রকল্প রয়েছে একটি। এ ক্ষেত্রে চলতি অর্থবছর ৪১টি প্রকল্প সমাপ্ত হচ্ছে না।

পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগের প্রধানের অভিমত হলো, প্রকল্প গ্রহণকালে সঠিকভাবে সমীক্ষা বা জরিপ না হওয়ার কারণে বেশির ভাগ প্রকল্প সংশোধন করার প্রয়োজন হয়। ফলে এক দিকে প্রকল্প বাস্তবায়নকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে, অন্য দিকে নতুন প্রকল্প গ্রহণের কারণে ক্রমান্বয়ে অর্থের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিকল্পনা ও আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার্থে প্রতিটি প্রকল্প গ্রহণকালে সঠিকভাবে সমীক্ষা বা জরিপ করা প্রয়োজন।

অর্থ বিভাগের সচিব বর্ধিত সভায় বলেন, বর্তমানে বিশ্বে মন্দাভাব বিরাজ করছে। ফলে আমদানি-রফতানি কমছে। সর্বশেষ হিসাবে রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম সংগৃহীত হয়েছে। বছরান্তে রাজস্ব আহরণ আশানুরূপ হওয়ার সম্ভাবনা কম। তা ছাড়া করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে, তা নিশ্চিত নয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে এডিপির আকার বিশেষ করে স্থানীয় উৎসের অর্থ হ্রাস পাওয়ার কথা। কিন্তু সার্বিকভাবে দেশের উন্নয়নের বিষয় বিবেচনা করে স্থানীয় মুদ্রার পরিমাণ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। তবে অর্থের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।

উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের হার কমেছে। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হার ২ দশমিক ০৪ শতাংশ কমেছে। করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) কারণে কিছুটা প্রভাব এডিপিতে পড়ছে। মেগা, বড়, ছোট সব প্রকল্পেই একই অবস্থা।

আর পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, প্রথম আট মাসে বাস্তবায়ন হার ৩৭ দশমিক ০৯ শতাংশ। করোনার প্রভাব পড়লেও খুব বেশি আশঙ্কার কিছু নেই। তবে বাস্তবায়নে দেরি হয় প্রায়ই। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। তিনি জানান, চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এডিপি বাস্তবায়নের হার গত অর্থবছরে একই সময়ের চেয়ে কিছুটা কম। গত অর্থবছর বাস্তবায়ন হার ছিল ৩৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। তবে টাকার অঙ্কে আগের বছরের চেয়ে এ বছর অর্থ ব্যয় বেশি; যা ৯ হাজার কোটি টাকা।