প্রচ্ছদ ধর্ম প্রশিক্ষণের মাস রমজান

প্রশিক্ষণের মাস রমজান

মুসলমানদের জন্য আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে একটি বরকতময় মাস মাহে রমজান। এ মাসের মর্যাদায় তিনি তার রহমতের ভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দেন। বোখারি শরীফে বর্ণিত- ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সঙ্গে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে রমজান মাসে রোজা রাখে, আল্লাহ তার আগের সব গোনাহ মাফ করে দেন।’

নাসায়ী শরীফের অপর এক হাদিসে বলা হয়েছে- ‘রমজান মাসে বেহেশতের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলা হয় শয়তানকে।যাতে করে মানুষ তাঁর রহমত, করুণা ও মাগফিরাত লাভে ধন্য হয়।

যেহেতু এ মাসে শয়তানকে বেঁধে ফেলা হয়, তাই শয়তানের ধোকায় পড়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এর ফলে মানুষ সহজভাবে নিজেকে সংশোধন করে নেওয়ার সুযোগ পায়। বেহেশতের দরজা খুলে দিয়ে মানুষকে আহ্বান জানানো হয় সৎ কাজের দিকে। দোজখের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে অসৎ বা মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানানো হয়।

আল্লাহর পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এসব আয়োজন মূলতঃ পাপমুক্ত জীবন গঠনের লক্ষ্যে। কিন্তু আফসোসের বিষয় রমজানের ফজিলত সম্পর্কে উদাসীন কিংবা গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে আমরা আল্লাহ তাআলার রহমত ও করুণা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি।  আমরা রমজানের রোজা পালন করছি ঠিকই কিন্তু তা আমাদের পরিশুদ্ধ করতে পারে না। কেননা আমরা অনেকেই সঠিকভাবে রোজা পালন করছি না। রোজা রেখে আমরা শরীয়ত বিরোধী কাজ করছি যার ফলে স্রষ্টার অসীম করুণা লাভে ব্যর্থ হচ্ছি।

কিন্তু রমজান হচ্ছে সংযমের মাস, করনীয় ও বর্জনীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণের মাস। এ মাসে সঠিকভাবে এর প্রশিক্ষণ নিয়ে সে অনুযায়ী সবসময় কাজ করা বা আমল করা কর্তব্য। আমরা অনেকেই রোজা রেখে  তার আদব মেনে চলি না।  কিন্তু রোজার পূর্ণ ফজিলত ও আল্লাহর রহমত পেতে আমাদের সঠিকভাবে সিয়াম পালন করা উচিৎ। রাসূল (সা.) বলেছেন, রোজার সওয়াব অগনিত ও অসংখ্য। আল্লাহ কি পরিমাণ সওয়াব বান্দাকে দেবেন, তা তিনিই ভাল জানেন।

হযরত আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলের (সা.) কাছে এসে জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে এমন একটি কাজের আদেশ দিন যার দ্বারা আল্লাহ আমাকে উপকৃত করবেন। তখন রাসূল (সা.) বলেন, তুমি রোজা রাখ, রোজার সমতুল্য কিছু নাই। (নাসাঈ)

রোজার পূর্ণ সওয়াব বা ফজিলত পেতে আমাদের কিছু বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখা প্রয়োজন।যেমন- আগেভাগে সাহরি না খাওয়া। আমরা অনেকে আগেভাগে সাহরি খেয়ে ফেলি। কেউ কেউ রাত বারোটা বা একটার দিকে সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু এটি একদিকে সুন্নত বিরোধী কাজ। অন্যদিকে শেষ রাতে সাহরি গ্রহণে যে বরকত তা থেকে বান্দা বঞ্চিত হয়। তাছাড়া আগে সাহরি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে ফজরের নামাজও ছুটে যেতে পারে। আর তা হলে আরও বড় ধরনের অপরাধ হবে তাতে।

এ সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘তোমরা সাহরি খাও কারণ এতে বরকত রয়েছে।’ -(বোখারি ও মুসলিম)। অন্য এক হাদিসে এসেছে- ‘আমাদের ও আহলুল কিতাব (ইহুদী-খ্রিষ্টানদের) রোজার মাঝে পার্থক্য হল সাহরি খাওয়া।’ অর্থাৎ তারা সাহরি না খেয়ে রোজা পালন করে আর আমরা সাহরি খেয়ে তা পালন করি। -(মুসলিম ও তিরমিযি)

ইফতার করতে হবে দ্রুত।আমরা  অনেকে সূর্য ডুবে যাওয়ার পরও অধিক সতর্কতার যুক্তিতে দুই/তিন মিনিট দেরিতে ইফতার করি। এটা শয়তানের ওয়াসওয়াসার অনুসরণ ছাড়া আর কিছু নয়। কেননা রাসূল (সা.) বলেন- ‘ততদিন যাবত আমার উম্মত কল্যাণের মাঝে থাকবে যতদিন আগেভাগে (সূর্য ডুবার সাথে সাথে) ইফতার করবে।’-(সহিহ বোখারি)

রমজান মাস সংযমের মাস। সিয়ামের তাৎপর্য হচ্ছে সংযমী হওয়া বা সংযম পালন করা। অথচ অনেককেই রমজানে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়ে অসংযমী হতে দেখা যায় যা একবারেই অনুচিত। অপরিমিত খাওয়া-দাওয়ার ফলে ইবাদতেরও ব্যাঘাত ঘটে।

অসদাচরণ বা খারাপ ব্যবহার থেকে বিরত থাকতে হবে। অনেক রোজাদার আছেন রোজা রেখেও দ্রুত রেগে যান, কিংবা মানুষের সাথে খারাপ ব্যবহার করেন। মিথ্যা, গীবত ও চোগলখুরিতে লিপ্ত হযন। কিন্তু এরূপ আচরণ রোজার উপকারিতা ও হিকমতের পরিপন্থী। এর মাধ্যমে সিয়ামের সওয়াব বিনষ্ট হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে সিয়াম ব্যক্তিকে পবিত্র করে, তার চরিত্রকে সুন্দর করে, মুসলিম ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে সবর-ধৈর্য, দয়া-অনুকম্পা ও ব্যক্তিত্ব প্রকাশ করতে।

হাদিসে এসেছে- যে ব্যক্তি রোজা রাখা অবস্থায় মিথ্যা কথা ও কাজ পরিত্যাগ করে না, আল্লাহর কোনই দরকার নেই তার পানাহার ত্যাগ করাতে। -(বোখারি)

রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- ‘যখন তোমাদের কারো সিয়ামের দিন উপস্থিত হয় তখন সে যেন কোন অশ্লীল কথা ও কাজ না করে এবং অহেতুক উঁচু কণ্ঠে কথা বা ঝগড়া-বিবাদ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় বা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে তবে সে যেন তাকে বলে দেয়, আমি রোজা আছি।’ (বোখারি ও মুসলিম)

রোজা রেখে অযথা রাত জাগা ও ঘুমিয়ে দিন কাটানো ঠিক নয়। এ অভ্যাসের কারণে রোজা রেখে সঠিকভাবে ইবাদত বন্দেগী করা হয়ে উঠবে না। কখনো কখনো এর কারণে জামাতের সাথে সালাত বা নামাজ আদায় করা হয় না। ঘুমিয়ে দিন কাটালে অনেক সময় সালাতের সময়ও পার হয়ে যেতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

রাতে স্বপ্নদোষ হলে গোসল করা কর্তব্য। অনেকে লজ্জাবশতঃ রাতে গোসল করেন না। আর এভাবে ফজর নামাজ পরিত্যাগ করে বা সূর্যোদয়ের পর গোসল করে ফজর পড়ে। এটা নিতান্তই অজ্ঞতা ও গুনাহর কাজ। স্বপ্নদোষ হলে কিংবা স্বামী-স্ত্রী মিলনের মাধ্যমে নাপাক হলেও সাহরি খাওয়া যায়। তবে অবশ্যই ফজর নামাজের আগে গোসল করতে হবে এবং নামাজ আদায় করতে হবে।

রোজা পালনকারীদের তারাবিহ সালাত আদায় করা কর্তব্য। তারাবিহ না পড়ে  অনর্থক কোনো কাজে লিপ্ত থাকা উচিত নয়। বিশেষ করে তারাবিহ নামাজ না পড়ে টিভি, কম্পিউটার, ট্যাব, মোবাইল কিংবা  সিডি প্রভৃতির মাধ্যমে নাটক, সিনেমা ও অশ্লীল ছবি দেখে বা তাস, ক্যারাসবোর্ড প্রভৃতি অনর্থক খেলা খেলে বা গল্প-গুজব করে সময় অতিবাহিত করা ঠিক নয়।এতে করে আরও বড় ধরণের অপরাধ ও পাপ হবে।

রমজান মাস চলে যাওয়ার পরেও ইবাদত-নামাজ অব্যাহত রাখতে হবে। অনেকে আছেন রমজানে মসজিদে নিয়মিত নামাজ আদায় করেন। কিন্তু মাহে রমজান চলে যাওয়ার পর তাদের আর মসজিদে খুঁজে পাওয়া যায় না। দুনিয়াদারীতে তারা অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তখন  তাদের মসজিদে খুব কমই দেখা যায়। কেউ কেউ নামাজও ছেড়ে দেন। রমজান মাস শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নামাজ ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়। কেননা ঈমানের পর নামাজ হচ্ছে  ইসলামের সবচেয়ে বড় রোকন। ঈমান ও কুফরির বাহ্যিক মানদণ্ড হচ্ছে নামাজ। কিয়ামত দিবসে সর্ব প্রথম নামাজ সম্পর্কেই প্রশ্ন করা হবে।

দেখা গেছে রোজাদারদের অনেকেই রোজার ফজিলত, রোজার মাসআলা কিংবা বিধি-বিধান সম্পর্কে তেমন জ্ঞান রাখেন না। রোজা অবস্থায় কি করণীয় ও বর্জনীয়, কি করলে রোজা হালকা হয়ে যায়, কিসে নষ্ট হয়ে যায়, এ মাসে কোন ধরণের কাজ আল্লাহ পছন্দ করেন সে সম্পর্কে  জ্ঞান রাখেন না বা রাখার প্রয়োজন অনুভব করেন না। কিন্তু এমনটি হওয়া উচিত নয়।

সার্বিক অর্থে রমজান একটি প্রশিক্ষণের মাস, আখেরাত অর্জনের মাস, আত্মসংযম ধৈর্য ও সহনশীলতার মাস। এ মাসে নেক কাজের দিকে যেমন বেশি বেশি অগ্রসর হতে হবে, তেমনি মুক্ত থাকতে হবে সবধরনের পাপ কাজ থেকে। রাব্বুল আলামিন আমাদের রমজানের তাবৎ শিক্ষা জীবনের সর্বস্তরে বাস্তবায়নের এবং ফজিলতপূর্ণ আমল বেশি করে আদায় করার তাওফিক দান করুন। -আমিন।