বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :
ভারতে অবৈধ অভিবাসী সন্দেহে যে বিদেশিদের আটক করা হবে, তারা জামিন পেলেও তাদের বাইরে ছাড়া যাবে না – বরং ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টারে আটক রাখতে হবে বলে কর্নাটক হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছে।
হাইকোর্ট বলেছে, কোর্টের পরবর্তী নির্দেশ না-আসা পর্যন্ত বা তাদের নিজ দেশে ফেরত না-পাঠানো ডিটেনশন সেন্টারই হবে তাদের ঠিকানা।
ব্যাঙ্গালোরে আটক জনা পনেরো কথিত বাংলাদেশির জামিনের আবেদনে রায় দিতে গিয়েই আদালত এ কথা বলেছে।
মানবাধিকার কর্মীরা ও অনেক আইনি বিশেষজ্ঞই এই রায়ের তীব্র সমালোচনা করছেন, তাদের মতে কোনও ব্যক্তির নাগরিকত্বের নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকাল তাকে এভাবে ডিটেনশন সেন্টারে আটকে রাখাটা চরম অমানবিক।
‘’বাবলু খান ও অনান্যরা বনাম কর্নাটক সরকারে’’র যে মামলায় এই রায়টি দেওয়া হয়, সেটির সূত্রপাত বাংলাদেশি সন্দেহে পনেরোজন নারী-পুরুষ ব্যাঙ্গালোর পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর।
পুলিশের অভিযোগ, কোনও পাসপোর্ট ও ভিসা ছাড়াই এরা অবৈধভাবে ভারতে ঢুকেছেন – ফলে তাদের বিরুদ্ধে ফরেনার্স অ্যাক্টে মামলা আনা হয়েছে।
এছাড়া ওই দলের একজনের কাছে কয়েকটি বুলেটও নাকি পাওয়া গেছে, ফলে চার্জ আনা হয়েছে আর্মস অ্যাক্ট বা অস্ত্র আইনেও।
গ্রেপ্তারের পর এই কথিত বাংলাদেশিরা যখন হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন, তখনই এই রায়টি এসেছে।
ব্যাঙ্গালোরের মানবাধিকার আইনজীবী মৈত্রেয়ী কৃষ্ণান বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, “একটা জামিনের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত এখানে যে রায় দিয়েছেন সেটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।”
“এটা বিশাল লম্বা একটা রায়, অবৈধ বিদেশিদের নিয়ে কী করতে হবে তার একটা বিশাল নির্দেশিকাও সেখানে জুড়ে দেওয়া হয়েছে।”
“পুরোটা আমি এখনও পড়ে উঠতে না-পারলেও মোদ্দা কথাটা এটাই – এরা যদি জামিনও পান বা জেল থেকে ছাড়াও পান, তারপর এদের ডিটেনশন সেন্টারে ভরে দিতে হবে।”
আসামের ডিটেনশন সেন্টারগুলোর অভিজ্ঞতা
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ইতিমধ্যেই সন্দেহভাজন বিদেশিদের জন্য অনেক ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে, আর সেগুলোকে নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি।
কর্নাটক বা মহারাষ্ট্রের মতো আরও অনেক রাজ্যেও এই ধরনের ডিটেনশন সেন্টার চালু হওয়ার অপেক্ষায়।
পর্যবেক্ষকরা অনেকেই মনে করছেন, কর্নাটক হাইকোর্টের বিচারপতি কে এন ফণীন্দ্র-র এই রায় এই সেন্টারগুলোকেই এক ধরনের বৈধতা দিচ্ছে।
এই সব বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন গবেষণা ও লেখালেখি করছেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট সাংবাদিক অরিজিৎ সেন।
তিনি বলছিলেন “ডিটেনশন সেন্টার বলতেই আমাদের সামনে প্রথমেই আসামের ছবিটা ভেসে ওঠে।”
“আর সেই সেন্টারগুলোতে যেভাবে বাসিন্দাদের ট্রিট করা হয়, যেভাবে স্টিগমাটাইজেশনের বিষয়টা আসে – তাতে পুরোটাই মানবাধিকারের একটা বিরাট লঙ্ঘন। এখানে পাঠালে যে কী হবে, সেই প্রশ্ন তাই থেকেই যায়।”
“আর একটা বিষয় হল, যার নাগরিকত্বের ফয়সালাই হয়নি – মানে কোথা থেকে এসেছেন না-এসেছেন সেটা নিশ্চিতভাবে জানাই যায়নি – তার ক্ষেত্রে তো এভাবে ইচ্ছেমতো ডিটেনশন করাই যায় না!”
ডিটেনশন সেন্টার ‘কফিনে শেষ পেরেক’
বস্তুত ভারতের আদালত বা ট্রাইব্যুনালে কেউ অবৈধ বিদেশি বলে শনাক্ত বলে তার পরেই তাকে ফরেনার্স ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানোর প্রশ্ন আসে।
আইনজীবী দর্শনা মিত্র বলছিলেন, সেটা হলেও কিন্তু তার সব অধিকার কেড়ে নিয়ে দিনের পর দিন সেই সেন্টারে আটকে রাখা যায় না।
তার কথায়, “অবৈধ অভিবাসী হলেও তাকে যত দিন খুশি আটকে রাখা যায় না কিন্তু! এটা সংবিধানের আর্টিকল ২১ বা জীবনের অধিকারের লঙ্ঘন, এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের পরিষ্কার রায়ও আছে।”
“আর ওরা যে বলছেন বাংলাদেশে ফেরত না-পাঠানো পর্যন্ত ওদের ডিটেনশন সেন্টারেই রাখতে হবে, সেখানেও ফেরত পাঠানো তো তখনই সম্ভব যখন দুটো দেশ তাদের বাংলাদেশি পরিচয় নিয়ে একমত হচ্ছে।”
“এই প্রক্রিয়ায় অনেক বছরও লেগে যেতে পারে, তবু সুড়ঙ্গের শেষে একটা আলোর আশা থাকে – যে একদিন হয়তো সে নিজের বাড়িতে ফিরে যেতে পারবে।”
“কিন্তু ফরেনার্স অ্যাক্টের আওতায় কাউকে ডিটেনশন সেন্টার পাঠানো হলে সেটা কিন্তু একটা সিভিল ডিটেনশন – যেখানে জামিনের কোনও সুযোগই নেই। সেই লোকটি ওখান থেকে বেরোতেই পারবে না”, বলছিলেন দর্শনা মিত্র।
ফলে এই ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানোর সিদ্ধান্তকে ওই ব্যক্তির ‘কফিনে শেষ পেরেক’ বলেই বর্ণনা করছেন তিনি।
বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই ভারতের নানা প্রান্তে কথিত অবৈধ বাংলাদেশি-দের বিরুদ্ধে ঢালাও অভিযান চলছে।
কর্নাটক হাইকোর্টের সাম্প্রতিকতম রায় সেই সব অভিযানে আটক ব্যক্তিদের আইনি অধিকারকেই যথারীতি আরও সঙ্কুচিত করবে, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই।