প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ চলন্ত বাসে নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিল চালক ও দুই...

চলন্ত বাসে নার্স তানিয়াকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিল চালক ও দুই হেলপার

স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসের চালক নূরুজ্জামান নূরু, হেলপার লালন মিয়া এবং বাসচালক নূরুজ্জামান নূরুর খালাতো ভাই ও বাসের অপর হেলপার বোরহান এই তিনজনে মিলে পালাক্রমে ধর্ষণ করে নার্স শাহিনূর আক্তার তানিয়াকে। পরে ঘটনাটিকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে তানিয়াকে বাস থেকে নিচে ফেলে দেয়া হয়। এতে মাথা থেতলে গিয়ে গুরুতর আহত হয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তানিয়া।

গত সোমবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে এই ঘটনার সোয়া দুই ঘণ্টা পর রাত পৌনে ১১টার দিকে স্বর্ণলতা পরিবহনের কটিয়াদীর কাউন্টার মাস্টার মো: রফিকুল ইসলাম রফিক এবং স্বর্ণলতা পরিবহনের সুপারভাইজার আল আমিন তানিয়ার নিথর দেহ কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়।

পাশবিক অত্যাচার ও বাস থেকে ফেলে দিয়ে গুরুতর আহত হওয়ার পর দুই ঘণ্টারও বেশি সময় চিকিৎসা না পেয়ে তানিয়ার মৃত্যু হয়। গতকাল শনিবার রাতে তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এ দিকে স্বর্ণলতা পরিবহনের বাসটি পুলিশ জব্দ করার পর আলামত ও নমুনা সংগ্রহ করেছে সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিট। শনিবার বিকেলে ময়মনসিংহের সিআইডির ক্রাইমসিন ইউনিটের একটি টিম বাজিতপুর থানায় রাখা বাসটি থেকে আলামত ও নমুনা সংগ্রহ করেন।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাজিতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো: সারোয়ার জাহান জানান, বাসচালক নূরুজ্জামান নূরু ও হেলপার লালন মিয়া রিমান্ডে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা ঘটনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে।

তারা জানিয়েছে, ঘটনার সময়ে বাসটিতে বাসচালক নূরু ও হেলপার লালন মিয়া ছাড়াও বোরহান নামে আরেকজন ছিল। বোরহান নূরুর খালাতো ভাই এবং বাসটির অপর হেলপার। তার বাড়িও গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তাকে ধরতে পুলিশ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে বলেও তিনি জানান।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, কটিয়াদী বাসস্ট্যান্ড থেকে বাসটি পিরিজপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়ার সময় চালকের আসনে বসে হেলপার লালন মিয়া বাসটি চালাচ্ছিল। রাত ৮টার দিকে পথে গজারিয়া এলাকায় একটি কলাবাগানের পাশে বাসটি থামিয়ে তানিয়ার ওপর পাশবিক অত্যাচার চালানো হয়। তানিয়ার চিৎকার যেন বাইরে না যায় এ জন্য বাসের দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়।

লালনকে চালকের আসনে রেখে বাসচালক নূরু মিয়া হামলে পড়ে তানিয়ার ওপর। তানিয়া সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে রক্ষা করতে গেলে বাসে থাকা অপর হেলপার বোরহান তানিয়াকে ধরে রাখে। এ সময়ে লালন ধীরে ধীরে বাসটিকে চালাতে থাকে। চলন্ত বাসটিতে তিন ধর্ষকের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়ে বাসেই লুটিয়ে পড়ে তানিয়া।

পরে ঘটনাটিকে সড়ক দুর্ঘটনা হিসেবে চালিয়ে দিতে তানিয়াকে বাস থেকে নিচে ফেলে দেয় ধর্ষকেরা। এতে মাথায় গুরুতর আঘাত পান তানিয়া। রক্তাক্ত ও অচেতন অবস্থায় সড়কে পড়ে থাকেন তানিয়া। এ অবস্থায় তানিয়া বাস দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন জানিয়ে তাকে রাত সাড়ে ৮টার দিকে পিরিজপুর বাজারের সততা ফার্মেসিতে নেয়া হয়। সততা ফার্মেসির হাবিবুর রহমান মেয়েটিকে দেখে তাকে দ্রুত কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। বাসের চালক ও হেলপার মেয়েটিকে একটি সিএনজিতে তুলে দিয়ে হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করেন।

কিন্তু অচেনা কোনো মেয়েকে একা হাসপাতালে নিতে কোনো সিএনজি রাজি না হওয়ায় তানিয়াকে আবার বাসে তুলে নেয় ধর্ষকদল। প্রায় দুই ঘণ্টা মুমূর্ষু তানিয়াকে নিয়ে এখানে-সেখানে ঘুরাফেরার পর কটিয়াদীর কাউন্টার মাস্টার মো: রফিকুল ইসলাম রফিক ও সুপারভাইজার আল আমিন একটি সিএনজিতে করে তানিয়ার নিথর দেহ কটিয়াদী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। ততক্ষণে তানিয়া চলে যান না-ফেরার দেশে।

এ দিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ মামলার তদন্তের সর্বশেষ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য রোববার ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন কিশোরগঞ্জের আসছেন বলে পুলিশ সুপার মো: মাশরুকুর রহমান খালেদ, বিপিএম (বার) জানিয়েছে।

এ দিকে পাশবিক এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় কিশোরগঞ্জে ক্ষোভ-বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। শনিবার সকালে জেলা শহরের আখড়াবাজার ব্রিজসংলগ্ন পরম চত্বরে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন, প্রতিবাদ সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে মানবাধিকার নাট্য পরিষদ কিশোরগঞ্জ জেলা শাখা, সামাজিক আন্দোলন কিশোরগঞ্জ জেলা শাখাসহ একাধিক সংগঠন। কর্মসূচিতে মানবাধিকার নাট্য পরিষদের সভাপতি হারুন আল রশীদ, জেলা পাবলিক লাইব্রেরিব সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক খান রতন, জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সংস্কৃতিকর্মী বাঁধন সরকার, শিপন করিম, নিগার সুলতানা উজমা, আইনজীবী অশোক সরকার প্রমুখ। পরে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। বক্তারা চলন্ত বাসে নার্স তানিয়াকে গণধর্ষণ শেষে হত্যার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান এবং জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানান।

তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় গতকাল কিশোরগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় আরো কয়েকটি মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশের শহরে পরিণত হয়। এসব মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশে ১০টিরও বেশি রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন অংশ নেন। এ সময় হাজার হাজার মানুষ মানববন্ধন ও প্রতিবাদ মানববন্ধন ও সমাবেশে মিলিত হয়ে তানিয়া ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িতদের ফাঁসির দাবি জানান।