প্রচ্ছদ আজকের সেরা সংবাদ করোনা দমনে চীনের সফলতা নিয়ে এত সন্দেহ কেন?

করোনা দমনে চীনের সফলতা নিয়ে এত সন্দেহ কেন?

বিডি রিপোর্ট টোয়েন্টিফোর ডটকম :

গত ডিসেম্বরে চীন থেকে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে করোনা ভাইরাস (কভিড-১৯)। এরপর থেকে পুরো বিশ্বজুড়ে অপ্রতিরোধ্য গতিতে তাণ্ডব চালাচ্ছে ভাইরাসটি। ইতিমধ্যে কেড়ে নিয়েছে ৮৩ হাজারের বেশি প্রাণ। আক্রান্ত করেছে প্রায় সাড়ে ১৪ লাখ মানুষকে। দেশে দেশে সরকাররা একে থামাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সর্বশক্তি প্রয়োগ করেও মৃত্যুর মিছিল থামাতে পারছেন না। এই অবস্থায় সবাইকে চমকে দিয়ে ভাইরাসটিকে পরাজিত করার খবর দিয়েছে এর উৎপত্তিস্থল চীন। মঙ্গলবার কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশটিতে করোনা ভাইরাসে নতুন কোনো মৃত্যু হয়নি।

গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশটিতে ভাইরাসের সংক্রমণের হার কমার খবর প্রকাশিত হয়ে আসছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার দাবি করে আসছে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। ভাইরাসটির প্রকৃত উৎপত্তিস্থল উহান থেকে লকডাউনও তুলে নেয়া হয়েছে। শহরটিতে মানুষজন আসা-যাওয়া শুরু করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনেকেই চীনের এই জয় নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন। তাদের সরকারি তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে এই সন্দেহ ও অবিশ্বাসের কারণ ব্যাখ্যার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, চীনের সফলতার জন্য দেশটির প্রশংসা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু সংস্থাটির সঙ্গে একমত নন অনেকেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পতো সংস্থাটির বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগও এনেছেন। অর্থায়ন কমিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন। তিনি নিজেও, চীনের তথ্য নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, এ তথ্য অনেকটা ইতিবাচক দিকে রয়েছে। মার্কিন আইনপ্রণেতারাও চীনের তথ্য সঠিক না হওয়ার দাবি করেছেন। গত সপ্তাহে বৃটিশ মন্ত্রী মাইক্যাল গোভ বলেছেন, চীনের তথ্যগুলোয় ভাইরাসটিতে আক্রান্তের প্রকৃত মাত্রা, ধরণ ও সংক্রমণের হারের ব্যাপারগুলো অস্পষ্ট।
চীনের প্রতি এ অবিশ্বাসের পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, তাদের তথ্য গোপনের ইতিহাস ও প্রাথমিক পর্যায়ে ভাইরাসটি সম্পর্কে তথ্য ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা।

তথ্য গোপনের ইতিহাস
সরকারি হিসাবের ক্ষেত্রে বিশ্ব বিশ্বাস করবে এমন সংখ্যা প্রকাশের জন্য কুখ্যাত চীন। বিশেষ করে, তাদের অর্থনীতি বিষয়ক তথ্যের ক্ষেত্রে এই অবিশ্বাস অনেক বেশি দেখা যায়। বেশিরভাগ দেশের ক্ষেত্রে তাদের প্রান্তিক জিডিপি তথ্যকে দেশগুলোর সত্যিকার অর্থনৈতিক অগ্রগতি বা অবনতির প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু চীনের ক্ষেত্রে ওই তথ্য অনেকটা সত্যিকার তথ্যের দিকে নির্দেশিকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। করোনা মহামারীর আগে, চীন সরকার চলতি বছরে ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছিল। বহু বছর ধরে এমন ঠিক করা লক্ষ্যমাত্রা প্রায় যথাযথভাবেই অর্জন করে আসছে চীন। অন্তত তথ্যের দিক দিয়ে তাতে কোনো ঘাটতি নেই। কিন্তু চীনের বাইরে কিছু অর্থনীতিবিদ মনে করেন, ওই তথ্য সঠিক নয়। তা কেবল কাগজে-কলমেই ঠিক। চীনের সমকক্ষ অন্যকোনো অর্থনীতি এত সুষ্ঠুভাবে লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ধারা ধরে রাখতে পারেনি। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি মাঝে মাঝে এধরনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত না হলেও কাগজে-কলমে ভিন্নকথা প্রকাশ করে। বাস্তবতা যাইহোক ভার্চুয়ালি হিসাব ঠিক রাখে। বেশকিছু প্রাদেশিক কর্মকর্তাকে জিডিপি নিয়ে প্রকৃত তথ্য গোপনের দায়ে জনসম্মুখে শাস্তিও দেয়া হয়েছে।
চীন যদি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তথ্য লুকাতে পারে তাহলে, করোনা ভাইরাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তথ্য লুকানোও অস্বাভাবিক নয়।

প্রাথমিক পর্যায়ে তথ্য ধাপাচাপার চেষ্টা
করোনা দমনে চীনের সফলতার দাবি অবিশ্বাসের আরেকটি কারণ হচ্ছে, মহামারিটির প্রাথমিক পর্যায়ে তথ্য ধাপাচাপার চেষ্টা। এমনকী ভাইরাসটির সংক্রমণ রোধে প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থতাও এই অবিশ্বাস জোরদার করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে ভাইরাসটি নিয়ে চীন প্রথম তথ্য জানায় ৩১শে ডিসেম্বর। কিন্তু ভাইরাসটি এর আগ থেকেই সেখানে বিস্তার করেছিল। উহানের চিকিৎসক ডা. লি ওয়েনলিং নিজের সহকর্মীদের এ ব্যাপারে সতর্ক করে জানিয়েছিলেন, ২০০২ সালের করোনা ভাইরাসের (সারস) মতো একটি কিছু একটা বিস্তার লাভ করছে। এজন্য তাকে আটক করেছিল পুলিশ। মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বাধ্য করেছিল। তার মতো অন্যান্য হুইসেলব্লোয়ারদেরও চুপ করিয়ে দেয়া হয়েছিল। ওয়েনলিং পরবর্তীতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারান।
কয়েক সপ্তাহ আগে উহানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক প্রমাণ করতে সেখানে সফর করেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। তখন চীনের মূল ভূখণ্ডের মধ্যে হুবেই ছাড়া অন্যকোথায় সংক্রমণ ছিল না বলে খবর প্রকাশিত হয়। জিনপিংয়ের সফরের সময় জাপানি বার্তা সংস্থা কিয়োদোর এক খবরে, অজ্ঞাত পরিচয়ের এক চিকিৎসকের বরাত দিয়ে বলা হয়, কর্মকর্তারা জিনপিংকে নতুন আক্রান্তের তথ্য প্রকাশ না করতে পরামর্শ দেন। এর মধ্যে মার্কিন গণমাধ্যমে গোয়েন্দা সূত্রের বরাতে খবর প্রকাশিত হয়, চীন ইচ্ছাকৃতভাবে সঠিক তথ্য প্রকাশ করছে না।

আক্রান্তের সংজ্ঞার নানা রূপ
চীনের প্রকাশিত তথ্য সত্য হিসেবে বিবেচিত করা হলেও, সে তথ্যের সম্পূর্ণতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চের শুরু পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হওয়া নিয়ে সাতটি ভিন্ন সংজ্ঞা দিয়েছে। উহানের এক বন্যপ্রানী বেচাকেনার বাজার থেকেই ভাইরসটি প্রথম মানুষের দেহে প্রবেশ করে বলে বিশ্বাস করেন বিজ্ঞানীরা। মহামারির প্রাথমিক পর্যায়ে ওই বাজারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব ব্যক্তি জটিল নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন তাদের পরীক্ষা করা হয়েছে। পরবর্তীতে পরীক্ষা আরো বিস্তৃত করা হয়। হংকং ইউনিভার্সিটির স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক বেন কওলিং জানান, পরবর্তীতে যে পরিধির আওতায় পরীক্ষা করা হয়েছে, প্রথম থেকে সে আওতায় পরীক্ষা হলে এখন চীনে আনুমানিক আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ ৩২ হাজারের মতো হতো।

এছাড়া, উপসর্গহীন আক্রান্তের সংখ্যাও গত সপ্তাহ পর্যন্ত সরকারি হিসাবে যোগ করা হয়নি। যদিও সেগুলো শনাক্ত করা হয়েছিল। অধ্যাপক কওলিং জানান, এমন আক্রান্তের সংখ্যা আনুমানিক ২০ শতাংশ। চীনের তথ্য গোপনের ব্যাপারটা ফুটে উঠেছে তাদের কর্মকর্তাদের কথায়ও। গত সপ্তাহে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কেকিয়াং এক বিবৃতিতে, সকল স্থানীয় কর্মকর্তাকে তথ্য প্রকাশে স্বচ্ছতা বজায় রাখতে আহ্বান জানান।

দেশে ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের পর এখন অন্যান্য দেশকে সহায়তা করছে চীন সরকার। এমনকি, একটি সম্ভাব্য টিকার মানবদেহে প্রাথমিক পরীক্ষা শেষ করার দাবিও করেছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে তারা আদতে সফল হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত নয়। তবে এটা নিশ্চিত যে, তারা প্রমাণ করতে চাইছে- ভাইরাসের উৎপত্তি দেয়া দেশটি, ভাইরাসটি শেষ করতেও সক্ষম।