প্রচ্ছদ এক্সক্লুসিভ সংবাদ করোনাকালে জাকাত ও ত্রাণে সতর্কতা

করোনাকালে জাকাত ও ত্রাণে সতর্কতা

এইচ এম মুুহিব্বুল্লাহ :

কোভিড-১৯ বা করোনা আমাদের বিবেকের দুয়ার খুলে দিচ্ছে। আমাদের অহঙ্কার অহমিকাকে ধুলায় মিশিয়ে মানবতার প্রাচীরকে সুদৃঢ় করার বার্তা দিচ্ছে। সুস্থ ও সুন্দর মনের সামর্থ্যবানরা এগিয়ে যাচ্ছি অসহায়দের পানে। অসহায় মানুষের আর্তনাদে বিগলিত হচ্ছে আমাদের হৃদয়। এটিই তো ইসলামের সৌন্দর্য। তবে আমরা এ সৌন্দর্য বর্ধন করতে গিয়ে যে সম্পদ ব্যবহার করছি সেটি হয় ব্যক্তিগত, নয় জাকাতের। আমরা একটু জেনে নেবো জাকাত ও ত্রাণের পরিচয়। এরপর দেখব যে, আমাদের দেয়া ত্রাণ সঠিক পন্থায় হচ্ছে কি না। 

জাকাত, ত্রাণের পরিচয় ও পার্থক্য : জাকাত একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো বৃদ্ধি পাওয়া, পরিশুদ্ধ হওয়া ইত্যাদি। এটি ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের একটি। জাকাত ইসলামের যেমন একটি ফরজ বিধান তেমনি এটি ইসলামের একটি সৌন্দর্যও বটে। দ্বিতীয় হিজরিতে মুসলিমদের ওপর জাকাত ফরজ হয়। প্রত্যেক স্বাধীন, পূর্ণবয়স্ক মুসলিম নর-নারীকে প্রতি বছর স্বীয় আয় ও সম্পত্তির নির্ধারিত পরিমাণ (তথা ৫২.৫ তোলা রুপা অথবা ৭.৫ ভরি স্বর্ণ কিংবা সমপরিমাণ সম্পদ পূর্ণ বছর অতিক্রম করলে তার শতকরা চল্লিশ ভাগের এক ভাগ) জাকাত দিতে হয়। বিত্তশালীদের সম্পদে দরিদ্রদের অধিকারের নামই জাকাত। জাকাত প্রদানে অলসতাকারীদের লক্ষ করে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন : যারা স্বর্ণ ও রৌপ্য পুঞ্জীভূত করে রাখে, আর তা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে না, (হে রাসূল!) আপনি তাদের বেদনাদায়ক আজাবের সুসংবাদ দিন। যেদিন জাহান্নামের আগুনে তা (স্বর্ণ ও রৌপ্য) গরম করা হবে, অতঃপর তা দ্বারা তাদের কপালে, পাশে এবং পিঠে সেঁক দেয়া হবে। (আর বলা হবে) এটা তাই যা তোমরা জমা করে রেখেছিলে, সুতরাং তোমরা যা জমা করেছিলে তার স্বাদ উপভোগ করো। (সূরা আত-তাওবা : ৩৪-৩৫) 

হালে লক্ষণীয় একটি বিষয়ের নাম ত্রাণ। এটি ইসলামের কোনো ফরজ বিধান নয় কিন্তু এটি ইসলামের বিউটি। একে আমরা সৃষ্টির সেবাও বলতে পারি। এটি প্রদান করার জন্য নিসাব পরিমাণ সম্পদ হওয়াটা যেমন মুখ্য নয় তেমনি এটি গ্রহণের জন্যও দরিদ্রতা কিংবা জাকাতের সম্পদ গ্রহণের আওতায় আসাও আবশ্যক নয়। এটি সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক ও স্বপ্রণোদিত বিষয়। এর দাতা ও গ্রহীতা যে কেউ হতে পারেন। অঞ্চলিক কিংবা বৈশি^ক মহামারীতে অভাবী, অসহায় কোনো ব্যক্তির পাশে খাদ্য, বস্ত্র কিংবা সম্পদের মাধ্যমে সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করে এগিয়ে আসা ধনই হচ্ছে ত্রাণ। তবে সতর্কতার বিষয় হচ্ছে যে, ত্রাণ যেন জাকাতের সাথে গুলিয়ে না যায়। ত্রাণ দেয়ার ক্ষেত্রে সচ্ছলতা কিংবা অসচ্ছলতা যাচাই করার বাধ্যবাধকতা নেই। বরং আপনার বিবেচ্য যেকোনো অসহায় ব্যক্তিই এটির প্রাপ্য হতে পারে। রাসূল সা: বলেন : যারা জমিনে আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে আসমানে যিনি আছেন তিনি তোমাদের প্রতি দয়া করবেন (তিরমিজি)।

সতর্কতা : এবার দু’টি বিষয়ের অস্পষ্টতা দূর করা যেতে পারে। আমরা জাকাত ও ত্রাণের পার্থক্য বুঝলাম। এবার আমরা জেনে নেবো জাকাতের অর্থ আমরা কাকে দেবো? এর পরিষ্কার উত্তর পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে। ‘জাকাত হলো কেবল ১. ফকির, ২. মিসকিন, ৩. জাকাত আদায়কারী ও ৪. যাদের চিত্ত আকর্ষণ প্রয়োজন তাদের হক এবং তা ৫. দাস মুক্তির জন্য, ৬. ঋণগ্রস্তদের জন্য, ৭.আল্লাহর পথে জিহাদকারীদের জন্য এবং ৮. মুসাফিরদের জন্য। এই হলো আল্লাহর নির্ধারিত বিধান। আল্লাহ সর্বজ্ঞ, প্রজ্ঞাময়।’ (সূরা তাওবা : ৬০) আলোচ্য আয়াতে বর্ণিত মুসলিম ব্যক্তিদের বাইরে কোনো অমুসলিমকে জাকাতের টাকা দেয়া যাবে না। তবে সাধারণ সদকা এমনকি সাদাকা তুল ফিতরও অমুসলিমদের দেয়া যাবে। রাসূল সা: হজরত মুআয রা:-কে ইয়ামেন প্রেরণকালে এভাবেই জাকাত বণ্টনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। সুতরাং, ইসলামী শরিয়াহ যাকে উপযুক্ত মনে করে জাকাতের অর্থ সরাসরি কিংবা উকিলের মাধ্যমে তার কাছে হস্তান্তর করাই যুক্তিযুক্ত হবে।

পক্ষান্তরে ত্রাণ দেয়ার লক্ষ্যে যে সম্পদ ব্যয় করা হবে তা ধনী, গরিব, মুসলিম কিংবা অমুসলিম যে কেউ অসহায় হলে সে গ্রহণ করতে পারবে। আর দাতারও এ ক্ষেত্রে মুসলিম হওয়া শর্ত নয়। তাই যে বা যারাই জাকাতের অর্থ দিয়ে ত্রাণ বিতরণ করছেন তাদের একটু সতর্ক হতে হবে। আপনার অজান্তে কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের জন্য সঠিকভাবে জাকাত আদায় নাও হতে পারে। 

বোঝা গেল যে, জাকাত আর ত্রাণের অর্থ ব্যবহার করার খাত এক নয়। সুতরাং, আপনি জাকাতের অর্থ দিয়ে যাকে ত্রাণ দিচ্ছেন তিনি হয়তো সেটি গ্রহণের অধিকারী নাও হতে পারেন। তাই জাকাতকে জাকাতের জায়গায় এবং নির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বনে আদায় করুন। পাশাপাশি করোনাকালীন এ মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত লোকদের দিকেও সাধ্যমতো সাহায্যের হাত প্রসারিত করুন। আল্লাহ এ দুর্যোগ থেকে আমাদের দেশসহ গোটা বিশ^কে মুক্তি দান করুন এবং মানুষের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিন। সেই সাথে এ বিপদ থেকে শিক্ষা অর্জন করে সমাজের উঁচু-নিচু, সাদা-কালো ও ধনী-গরিবের বৈষম্য চিরদিনের জন্য মুক্ত হোক। সুন্দর ও সজীবতায় পূর্ণ হোক আমাদের জীবন। সুন্দর পৃথিবীর প্রত্যাশাই হোক এ করোনার শিক্ষা।

লেখক : এমফিল গবেষক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়

ই-মেইল: [email protected]