প্রচ্ছদ বিশেষ প্রতিবেদন সৌদি আরবে নির্যাতন, দেশে ফিরে ঠাঁই হয় না পরিবারেও

সৌদি আরবে নির্যাতন, দেশে ফিরে ঠাঁই হয় না পরিবারেও

ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন হবিগঞ্জের সালমা (ছদ্মনাম)। মাত্র ১৫ দিনেই ভেঙে যায় তার সুখস্বপ্ন। গৃহকর্তার নির্যাতন থেকে বাঁচতে পালিয়ে চলে এসেছেন দেশে।

কিন্তু দেশে এসে আরেক বিরূপ অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় এই নারীকে। স্বামীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়েছে আগেই, সন্তানদেরও কাছে পাচ্ছেন না। নিজের জন্মদাতাও তাকে ফিরিয়ে নিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।

অনিশ্চয়তায় তাই সালমার দিন কাটছে নিরাপদ অভিবাসন নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে।

সেখানেই কথা হয় সালমার; সৌদি আরবে গৃহকর্তার নির্যাতনের কথা বলেন তিনি। জানান, চাকরি ছেড়ে বাংলাদেশ দূতাবাসে রেখে আসার কথা বললে গৃহকর্তা তা করেনি, উল্টো বেড়ে যায় নির্যাতনের মাত্রা।

সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গিয়ে সালমার মতো অনেককেই ফিরে আসতে হয়েছে গত কয়েক বছরে। তাদের মুখে এসেছে নানা ধরনের নির্যাতন, এমনকি ধর্ষণের কথাও।

নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে সালমা বলেন, “খানা দেয় না, মারপিট করে। চামুক (চামচ) আছে না? চামুক দিয়ে মারে। অনেক ধরনের কথা বলত। খারাপ কথাও বলত। আমি ওর খতা (কথা) শুনি নাই দেইখ্যা আমারে মারছে।

“একদিন আমারে কফি জ্বাল দিবার হতা (কথা) বলছে। কফি জ্বাল দিতাম গেছি। ও আমার পিছে পিছে গেছে। গেছে বাদে আমি টের পাইছি, বাদে আমি সইরা গেছি। আমারে অনেক ধরনের কথাবার্তা কইছে। এর বাদে আমার হাতে দরছে, হাতে দইরা নিচে ফালায়া দিছে। আমি কফি জ্বাল দিতে আছিলাম, আমার আতে (হাতে) ম্যাচ লাইট আছিল। ম্যাচ টোকা দিয়া ব্যাডার পাঞ্জাবিত লাগায়া দিছি।”

সালমা জানান, এরপরই নিজের ব্যাগ নিয়ে দ্রুত ওই বাড়ি থেকে পালিয়ে যান। বাসা ছেড়ে এসে রাস্তায় কয়েকজন বাঙালিকে পেয়ে জানান দেশে ফেরার আকুতির কথা।

“বাঙালিদের বলছি, আমি দেশে যাইয়াম। কয় দেশে যাওয়ার দরহার (দরকার) নাই, অ্যাম্বাসিতে লও বাদে আমরাও যায়াম অ্যাম্বাসিতে। অনেক ধরনের মেয়েরা আছে অ্যাম্বাসিতে। অনেকে দেখছি কেউর পাউ (পা) বাঙ্গা (ভাঙা), কেউর আত (হাত) বাঙ্গা, অনেক মেয়েরে ইস্তারি (ইস্ত্রি) লাগায়া দেয় শইল্য (শরীরে)।”

সালমা জানান, দেশে ফেরার পর সন্তানদের কাছে ফিরতে পারছেন না, কারণ তার বাবা শামসু মিঞাই তাকে পরিবারে ঠাঁই দিচ্ছেন না।

এ বিষয়ে জানতে শামসু মিঞার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, মেয়েকে নিষেধ করার পরও সৌদি আরব গিয়েছিল। তার উপর কোনো যোগাযোগ করেনি।

কিন্তু ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মকর্তারা বলছেন, শামসু মিঞাকে ফোন করে মেয়ের দেশে ফেরার খবর জানানোর পর তাকে নিতে অনাগ্রহ দেখাননি তিনি।

মেয়েকে ফেরত নেবেন কি না- এ প্রশ্নে শামসু মিঞা বলেন, চেষ্টা করে দেখবেন।

বাংলাদেশি অভিবাসীদের নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরীফুল হাসান। তিনি জানান, দেশে ফেরত গৃহকর্মীদের তাদের পরিবারের কাছে তুলে দিতে গিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়েছেন অনেক বার।

নির্যাতনের শিকার নারীদের পরিবার ফেরত নিতে না চাওয়ার কারণ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “পরিবারগুলোর সাথে কথা বলে দেখেছি, আমাদের সোসাইটি মনে করে সৌদি আরব থেকে কিংবা মধ্যপ্রাচ্য থেকে একটা মেয়ে টর্চারড হয়ে এসেছে, যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে এসেছে, এক অর্থে তারা মনে করে অচ্ছুত, খারাপ। সমস্ত দায়টা যেন মেয়ের। সমাজ তাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত থাকে না।”

তেমনই একটি ঘটনার প্রসঙ্গ টেনে শরিফুল বলেন, “কিছুদিন আগে আমি একজন মেয়ে পেয়েছিলাম যাকে ফেরত আনার পর তার হাজবেন্ডকে ফোন দিলাম। তিনি বললেন, ‘আমার ওয়াইফ তো মারা গেছে’। তার ওয়াইফের ট্রিটমেন্ট দরকার, টর্চারড হয়ে আসছে তারপরও তার কাছে তার ওয়াইফ মৃত। বেঁচে আছে তারপরও তার কাছে স্ত্রী মৃত।”

মধ্যপ্রাচ্যে নির্যাতিত হয়ে ফিরে আসা নারীদের কত শতাংশ শেষ পর্যন্ত পরিবার ঠাঁই পাননি, তার নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই।

শরিফুল হাসান বলেন, “প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রে আমরা দেখেছি যে মেয়েটা ফেরত আসছে তাকে নিতে প্রস্তুত থাকে না তার বাবা, স্বামী বা পরিবারের লোকজন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা বুঝিয়ে পরিবারকে রাজি করালেও মেয়েটা একঘরে হয়ে থাকে। এই সংখ্যাটা আমাদের ক্ষেত্রে শতভাগ মেয়েই কোনো না কোনোভাবে সঙ্কটে পড়ছে।”

নির্যাতিত হয়ে দেশে ফেরা নারী গৃহকর্মীদের সঠিক সংখ্যাও জানাতে পারেননি ব্র্যাকের এই কর্মকর্তা।

“গড়ে দু’শ’ মেয়ে প্রতি মাসে ফেরত আসছে। অন্ততপক্ষে ৭/৮ শ’ মেয়ে গত চার মাসে ফেরত এসেছে। ব্র্যাক গত কয়েক মাসে ১১৮ জন মেয়েকে দেশে ফেরত আনতে দূতাবাস, প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছে। তাদের মধ্যে ৮০ জনকে আমরা ফেরত আনতে পেরেছি।

“এর বাইরেও ব্যক্তিগতভাবে অনেকে আসে এই সংখ্যাটা একদম কম হবে না। গত দুই বছরে অন্তত হাজারখানেক মেয়ে ফিরে এসেছে, যাদের অধিকাংশই যৌন নির্যাতন বা অন্যান্য নির্যাতনের শিকার।”

২০১১ সালের এপ্রিলে সৌদি ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট কমিটি বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নিতে জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল।

তবে সৌদি আরবে কর্মরত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার ১৫০ জন গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকারে ‘শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের’ ঘটনা উঠে আসে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে। ফলে সমঝোতা স্মারক সই হলেও কোনো নারী কর্মী সৌদি আরবে যাননি।

এরপর গৃহকর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৫ সালে চুক্তি করে সৌদি আরব। সেই চুক্তিতে নারী গৃহকর্মীর ওপর জোর দিয়ে একজন নারীর বিপরীতে ২/৩ জন পুরুষ শ্রমিক নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। এরপরই শুরু হয় নারী গৃহকর্মী পাঠানো।

শরিফুল হাসান জানান, গত বছর ৮৩ হাজার ৩৫৪ জন নারী কর্মী পাঠানো হয়।

এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত পাঠানো হয় প্রায় ৩০ হাজার নারী। সব মিলিয়ে গত চার বছরে প্রায় পৌনে দুই লাখ নারী গৃহকর্মী পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের রক্ষণশীল মুসলিম দেশ সৌদি আরবে।

সৌদি ফেরত নারীরা নির্যাতনের কথা বললেও তা নাকচ করে আসছেন বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তারা।

অভিযোগ ওঠার পর সৌদি আরব ঘুরে এসে সংসদীয় একটি কমিটির সদস্যরা বলেছেন, ভাষা না জানা, খাবার ভালো না লাগা এবং ঘরের প্রতি অতি টানের কারণে বাংলাদেশি গৃহকর্মীরা দেশে ফিরতে চান।