প্রচ্ছদ বিশেষ প্রতিবেদন সাড়ে ৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভাতা লোপাট

সাড়ে ৬ হাজার মুক্তিযোদ্ধার ভাতা লোপাট

বরিশালে ৬ হাজার ৪৫৬ জন মুক্তিযোদ্ধার সম্মানী ভাতার প্রায় চার কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় বলছে, মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বাবদ এই টাকা মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় করেছে তারা। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা বলছেন, তাঁদের হাতে এই টাকা আসেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গরমিলটা শুরু হয়েছে বরিশালের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে। কিন্তু জেলা প্রশাসন বলছে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মন্ত্রণালয় থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানী ভাতা বাবদ প্রায় চার কোটি টাকা কম দেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে বরিশালে চারজন জেলা প্রশাসক বদলি হয়েছেন। কিন্তু আজও এ সমস্যার সমাধান হয়নি। ভাতাও বুঝে পাননি মুক্তিযোদ্ধারা।

মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, ‘আমার মনে হয়, পুরো টাকাটা লোপাট হয়ে গেছে। বরিশাল জেলা প্রশাসনের তৎকালীন কর্মকর্তারা টাকাটা মেরে দিয়েছেন।’

পুরো বিষয়টি জানতে বরিশালে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান শেখ রিয়াদ মুহাম্মদ নূর গত দুই বছরে কয়েক দফা তথ্য অধিকার আইনে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু মন্ত্রণালয় বরিশাল জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে। সমাধান না পেয়ে শেখ রিয়াদ তথ্য কমিশনে অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ২৮ আগস্ট ও ১০ অক্টোবর কমিশনে শুনানি হয়। কমিশন মন্ত্রণালয়কে সম্মানী ভাতা দিতে ব্যবস্থা নিতে বলে। গত ২৪ অক্টোবর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, তাদের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, মুক্তিযোদ্ধারা সম্মানী ভাতা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাঁরা ভাতা পাননি। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেয়।

জানতে চাইলে বরিশালের বর্তমান জেলা প্রশাসক এস এম অজিয়র রহমান বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। বিষয়টি জানা নেই। তবে যেহেতু মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়, আমি অবশ্যই খোঁজ নেব।’

বরিশালের সাবেক জেলা প্রশাসক হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পুরো বিষয়টি বিভ্রান্তিকর। আমি থাকাকালীন অনেক চেষ্টা করেছি বিষয়টি সমাধান করতে। আর্থিক বিষয় এমনিতেই স্পর্শকাতর। কিন্তু তাঁরা ভাতা পাননি, এটা ঠিক। ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসক ছিলেন শহিদুল আলম। তিনি অন্যত্র বদলি হয়ে গেছেন অনেক আগেই। তাই তাঁর এখন দায় নেই।’

সম্মানী ভাতা পাননি, এমন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেন, ২০১৪ সালের জুন থেকে ২০১৫ সালের মার্চ পর্যন্ত বরিশাল জেলার মোট ভাতাভোগী ছিলেন ৬ হাজার ২৩২ জন। ২০১৫ সালের এপ্রিলে আরও ২২৪ জন যুক্ত হয়ে মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৪৫৬। ওই সময় মুক্তিযোদ্ধারা প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ভাতা পেতেন। ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চের জন্য প্রত্যেক মুক্তিযোদ্ধার নামে ব্যাংক হিসাবে ১৫ হাজার টাকা করে জমা হওয়ার কথা। কিন্তু জমা হয় ১০ হাজার টাকা করে। আর এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত জমা হয় ১৫ হাজার টাকা করে। তাহলে তাঁদের এক মাসের (মার্চ) ভাতা কোথায় গেল, সেই প্রশ্নই তুলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা।

ধীরেন চন্দ্র বিশ্বাস, এনায়েতুর রহমান, আমীর আলী, আনোয়ার হোসেনসহ অন্তত ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা অভিযোগ করেন, গত তিন বছরে তাঁরা এ ভাতা পেতে অনেক দৌড়ঝাঁপ করেছেন। এখনো তাঁরা আশা ছাড়েননি। তাঁদের মতো অসহায় মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাঁচ হাজার অনেক টাকা। এই টাকায় এক মাস তাঁদের সংসার চলে যায়। তাঁদের প্রশ্ন, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় যদি তাঁদের জন্য ভাতা বরাদ্দ দিয়ে থাকে, তাহলে টাকাটা গেল কোথায়?

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমার কাছে এমন অভিযোগ এসেছে। অভিযোগটি গুরুতর। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বরাদ্দ টাকা কেন তাঁদের পরিশোধ করা হয়নি, তা আমি জেলা প্রশাসকের কাছে জানতে চেয়েছি। মন্ত্রণালয় এ টাকা বরাদ্দ দিলে অবশ্যই তাঁদের পাওয়ার কথা। কোথায় গলদ হয়েছে, আমরা খতিয়ে দেখছি।’

সূত্রঃ প্রথম আলো