টানা ১০ বার বাজেট দেওয়ার বিরল এক কৃতিত্বের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এ সময় বাজেটের আকার বেড়েছে, বেড়েছে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয়, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গড় প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি। উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার পথে বাংলাদেশ।
এ রকম এক প্রেক্ষাপটে ভোটকে সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে আগামী ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট উপস্থাপন করবেন অর্থমন্ত্রী। নতুন বাজেটে সবাইকে তুষ্ট করার ইচ্ছা অর্থমন্ত্রীর। তাই বাজেটে নতুন কর আরোপের চিন্তা নেই। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে কর কমানোর ঘোষণা দেবেন তিনি। নির্বাচনের ঠিক আগের বাজেটে অগ্রগতির বর্ণনাও দেবেন অর্থমন্ত্রী। জানাবেন বিভিন্ন খাতে এগিয়ে যাওয়ার কথা।
তবে অর্থমন্ত্রীর জন্য অস্বস্তিও কম নেই। মানুষে মানুষে বৈষম্য বেড়েছে। ধনী আরও ধনী হয়েছে, আর গরিব হয়েছে আরও গরিব। দেশের সব মানুষের আয় যদি হয় ১০০ টাকা, তাহলে সমাজের ওপরতলার, অর্থাৎ ১০ শতাংশ ধনী লোকের আয়ই হচ্ছে ৩৮ টাকা ১৬ পয়সা। আর সবচেয়ে গরিব ১০ শতাংশ মানুষের আয় হচ্ছে মাত্র ১ টাকা।
এ রকম এক পরিস্থিতিতে ভোটের বাজেট আপাতত দেশের মানুষকে খানিকটা স্বস্তি হয়তো দেবে, কিন্তু বৈষম্য কমাবে কতটা, সে প্রশ্নও উঠছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্বজুড়েই বাজেটের মূল দর্শন হচ্ছে সম্পদ ও আয়ের পুনর্বণ্টন। যেমন ধনীদের থেকে বেশি ও গরিবদের থেকে কম কর নিতে হবে। আমাদের বাজেটে বিষয়টি অনুপস্থিত।’ তিনি আরও বলেন, দারিদ্র্যের হার কমছে। কিন্তু চিন্তার বিষয় যে বাড়ছে আয়বৈষম্য, সম্পদবৈষম্য এবং ভোগবৈষম্য। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের (এসডিজি) মূল দর্শন হচ্ছে, কাউকে পেছনে ফেলা যাবে না। বাজেট করতে হবে একে মাথায় নিয়ে।
কেমন হবে নতুন বাজেট
আগামী বাজেটের আকার ধরা হতে পারে ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেট ৪ লাখ ২৬৬ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট ৩ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা, যাকে ভিত্তি ধরলে আগামী বাজেটের আকার বেশি ৯৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগামী বাজেটটি নির্বাচনী তো বটেই, গতানুগতিকও। এতে নতুন কোনো চমক থাকছে না। গত নয় বছরে সরকার কী কী করেছে এবং ভবিষ্যতে কী কী করতে চায়, অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে তার একটি ফিরিস্তি থাকবে। তবে আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ থাকবে আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য নিয়ে। ব্যয় যা করার করতেই হবে, কিন্তু নির্বাচন মাথায় রেখে নানা ছাড় দেওয়ায় আয়ের দিকটি এবার উপেক্ষিত হয়েছে। নতুন বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। বাড়াবেন গরিবদের জন্য ভাতার আওতা। কিন্তু ধনীদের কাছ থেকে আরও বেশি কর আদায়ের কৌশল নেই তাঁর।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বাজেটে কর শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) ৩৩ লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করবেন। কিন্তু এই টিআইএনধারীদের বেশির ভাগই তরুণ। ভালো একটি অংশ আবার সরকারি কর্মচারী। সুতরাং এই গোষ্ঠীর কাছ থেকে বেশি কর আদায়ের সুযোগ কম।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সক্ষমতার সঙ্গে সংগতি রেখে বাস্তবায়নযোগ্য বাজেট দেওয়া উচিত। তাঁর মতে, অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলোর অন্যতম হলো বেসরকারি বিনিয়োগ স্থবিরতা, টেকসই কর্মসংস্থান নেই, বৈদেশিক বাণিজ্যে চাপ।
জাহিদ হোসেন বলেন, এসডিজি অর্জনে অভ্যন্তরীণ খাত থেকেই বিপুল রাজস্ব আহরণ করতে হবে। যেহেতু রাজস্ব সংস্কারের আইনগুলো হচ্ছে না, তাই রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার, বিশেষ করে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার দিকে বেশি জোর দেওয়া উচিত। পাশাপাশি ভ্যাট, শুল্ক ও আয়কর আইনগুলো কীভাবে, কবে বাস্তবায়িত হবে, এর একটি পরিকল্পনা বাজেটে থাকা উচিত।
যেসব পরিবর্তন আসতে পারে
নির্বাচনের বছর হওয়ায় করের জন্য চাপাচাপি করা হবে না আগামী বাজেটে। আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক—সব ক্ষেত্রেই ছাড় বেশি থাকবে। কর ছাড়ে বড় পরিবর্তন আসবে করপোরেট করে। ব্যাংকের করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে ৩৭ দশমিক ৫ শতাংশ হতে পারে। তবে সিগারেট ও মোবাইল ফোন কোম্পানির করহার অপরিবর্তিতই থাকবে।
ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের কিছুটা স্বস্তি দেওয়া হবে। তাদের জন্য আরেকটা নতুন করহার থাকবে। এখন সর্বনিম্ন করহার ১০ শতাংশ। নতুন বাজেটে সাড়ে ৭ শতাংশ হারে আরেকটি করহারের স্তর তৈরি হতে পারে। অন্য হারগুলো অপরিবর্তিত থাকবে। এলাকাভিত্তিক ন্যূনতম করের পরিমাণও অপরিবর্তিত থাকছে। করমুক্ত আয়ের আগের সীমাই বহাল থাকতে পারে।
ভ্যাট হারেও বড় পরিবর্তন আসছে। নয়টি হারের পরিবর্তে পাঁচ হারের ভ্যাট হবে। অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাব অনুযায়ী এই হার হতে পারে ২, ৪, ৬, ১০ ও ১৫ শতাংশ। বর্তমানে দেড়, আড়াই, ৩, ৪, সাড়ে ৪, ৫, ৬, ১০ ও ১৫—এই ৯টি হারে ভ্যাট আদায় করা হয়। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে নতুন আইন চালু হবে। তখন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হওয়ার কথা। অন্যদিকে বাজেটে অগ্রিম ব্যবসায় ভ্যাট (এটিভি) ১ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ করা হতে পারে। অ্যাপসভিত্তিক সেবায় ভ্যাট বসতে পারে। অনলাইন বেচাকেনায় বসতে পারে ৫ শতাংশ ভ্যাট। আবার ছাড়ও থাকবে। ইন্টারনেট সেবামূল্যের ওপর ভ্যাট প্রত্যাহার করা হতে পারে।
এ ছাড়া কেজিপ্রতি দাম ১৫০ টাকা পর্যন্ত রুটি, বিস্কুট ও কেকের ভ্যাট অব্যাহতি থাকবে। ১৫০ টাকার কম দামি চপ্পল বা স্যান্ডেলে ভ্যাট থাকছে না। দেশে উৎপাদিত মোটরসাইকেল ও রেফ্রিজারেটর উৎপাদনে ভ্যাট অব্যাহতির মেয়াদ আরও এক বছর বাড়তে পারে। বিমার এজেন্ট কমিশনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট প্রত্যাহার করা হতে পারে।
স্থানীয় পর্যায়ে মোবাইল ফোন উৎপাদকেরা এবার কিছুটা সুবিধা পাবে। তবে মোবাইল ফোন আমদানি করলে সারচার্জ হবে ১ শতাংশ থেকে ২ শতাংশ। আর দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোনে উৎপাদন পর্যায়ে দুই বছর আগে যে সারচার্জ আরোপ করা হয়েছিল, সেটা এবার প্রত্যাহার করা হচ্ছে।
হেলিকপ্টারে চড়লে খরচ বৃদ্ধি পাবে। হেলিকপ্টার সেবার ওপর ২০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হচ্ছে। এ ছাড়া মদ ও মদজাতীয় পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্কের হার বৃদ্ধি করা হতে পারে।
রিকন্ডিশন্ড গাড়ির অবচয়ন সুবিধা কমতে পারে। এতে দাম বাড়তে পারে। চালের ওপর আবার আমদানি শুল্ক বসছে। এখন শুল্ক কর সব মিলিয়ে ২ শতাংশ দিতে হয়। তা আগের মতো ২৮ শতাংশে উন্নীত করা হতে পারে।
এ ছাড়া ট্যারিফ মূল্যে ব্যাপক পরিবর্তন হতে পারে। বর্তমানে চিনি, চা, বিস্কুট, চিপস, শ্যাম্পু, সাবান, মিনারেল ওয়াটার, কোমল পানীয়, জুসসহ ৪২২ ধরনের পণ্যে ট্যারিফ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। ট্যারিফ মূল্যের এই সংখ্যা কমিয়ে ৩০০-এর মতো করা হতে পারে।
গুগল, ফেসবুক, ইউটিউবসহ বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যম কর্তৃপক্ষের আয়কর কীভাবে নেওয়া হবে, তা নিয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা ছিল না। এদিকে এসব সামাজিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপনের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ থাকলেও তা আদায় করা যাচ্ছে না। এ বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা থাকবে বাজেটে।
এনবিআরের লক্ষ্য ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা
আগামী অর্থবছরে এনবিআরকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে। এনবিআরকে চলতি অর্থবছরের লক্ষ্য থেকে ৭১ হাজার কোটি টাকা বেশি আদায় করতে হবে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের সংশোধিত লক্ষ্য ২ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা।
অন্যবারের মতো আগামী বছরেও মূসক বা ভ্যাট থেকে আদায় করতে হবে সবচেয়ে বেশি, ১ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা। এরপরই ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে আয়কর আদায় করা হবে ১ লাখ ২০০ কোটি টাকা। আর শুল্ক খাতে এনবিআরকে ৮৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্য দেওয়া হচ্ছে।