প্রচ্ছদ সারাদেশ রাজশাহী বিভাগ রাজশাহীতে বাড়ছে ইংরেজি সাইনবোর্ডের প্রবণতা

রাজশাহীতে বাড়ছে ইংরেজি সাইনবোর্ডের প্রবণতা

রাজশাহী প্রতিনিধি: উচ্চ আদালতের নির্দেশের প্রায় পাঁচ বছর পরও সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডে বাংলা লেখা নিশ্চিত করা যায়নি। বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডে বাংলার চেয়ে ইংরেজির ব্যবহারই বেশি। স্ব-স্ব প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তাদের পণ্যগুলো ব্যান্ডের, বিদেশেও শোরুম রয়েছে-তাই ইংরেজির ব্যবহার। এছাড়া স্থানীয় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নামও ইংরেজি অক্ষরে লেখা। তবে অনেকেই জানেন না আদালতের এ রকম আদেশের কথা।

রাজশাহী মহানগরীর সাহেববাজার থেকে নিউ মার্কেট হয়ে শাহিদ এএইচএম কামরুজ্জামান চত্বর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডে বাংলার চেয়ে ইংরেজি শব্দে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নাম রাখার প্রবণতা বেশি। ওই রাস্তার দু’পাশে ৩৭০টি মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধ্যে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানারে বাংলা লেখা প্রায় ১২৭ টি, বাংলা-ইংরেজি প্রায় ৭৭টি, শুধু ইংরেজি প্রায় ১২৩ টি, আর ইংরেজি নাম বাংলায় লেখা ৪২টি। শতাংশের হিসেবে বাংলা লেখা ৩৪ দশমিক ৩২ শতাংশ, বাংলা-ইংরেজি প্রায় ২০ দশমিক ৮১ শতাংশ, শুধু ইংরেজি ৩৩ দশমিক ২৪ শতাংশ। আর ইংরেজি শব্দের বাংলায় ব্যবহার ১১ দশমিক ৩৫ শতাংশ।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৪ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ এক আদেশে দেশের সব সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার, গাড়ির নম্বরপ্লেট, সরকারি দফতরের নামফলক এবং গণমাধ্যমে ইংরেজি বিজ্ঞাপন ও মিশ্র ভাষার ব্যবহার বন্ধ করতে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে বলেন। সংবিধানের ৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এ ছাড়া বাংলা ভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭-এর ৩ ধারায়ও সরকারি অফিস, আদালত, আধা সরকারি ও স্বায়ত্ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব এবং অন্যান্য কাজে বাংলার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

এ বিষয়ে রাজশাহী কোর্টের অ্যাডভোকেট আবদুল মালেক রানা বলেন, আদেশ অনেক আগেই হয়েছে। সরকারি দফতরগুলোতে বাংলা প্রচলন রয়েছে। সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানারে বাংলা লেখার বিষয়টি আরো প্রচার-প্রচারণার প্রয়োজন রয়েছে। এছাড়া যে সকল প্রতিষ্ঠান এই আদেশ অবজ্ঞা করবে তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ, সেটা জরিমানাও হতে পরে।

বাংলা সাইনবোর্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের (রাসিক) মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, অতি দ্রুত নগরীর সাইনবোর্ড, বিলবোর্ডগুলোতে বাংলা লেখা নিশ্চিত করা হবে। এ বিষয়ে দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা হবে।

প্রগতিশীল নাগরিক সংহতির সদস্য সচিব কলামিস্ট শাহ জিয়াউদ্দিন বলেন, অনেক দিন থেকে এই আন্দোলন করে আসছেন তারা। দেশের সকল সরকারি বেসরকারি ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের বিলবোর্ড সাইনবোর্ড বাংলা অক্ষরে লেখা এবং সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করতে হবে। এছাড়া মহানগরীর সকল প্রকার সাইনবোর্ড ও বিলবোর্ডে বাংলা অক্ষরে লেখার জন্য সকল প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে রাসিক মেয়রের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

তিনি আরো বলেন, প্রাতিষ্ঠানের মালিকরা মনে করেন ইংরেজিটা বেশি ভলো। বাংলা হলে ‘অল্প শিক্ষিত’ এমন ভাব। বর্তমানে ইংরেজি নামটা ফ্যাশান হয়ে দাঁড়িয়েছে। এগুলোর জন্য কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো দায়ী। তারা মানুষের মধ্যে ইংরেজি নামের ধারণা চালু করছে।

অন্যদিকে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল, দোকানপাটে বেশির ভাগ সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। তবে সরকারি দফতরের সাইনবোর্ড বা নামফলক বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাংলায় লেখা।

এ ছাড়া যানবাহনের ডিজিটাল নম্বরপ্লেটগুলো বাংলায় সরবরাহ হওয়ার কারণে এ ক্ষেত্রে আদালতের নির্দেশ অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়েছে।

বহুজাতিক কোম্পানির প্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশেরই সাইনবোর্ড সম্পূর্ণ ইংরেজিতে লেখা। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ব্যবহারের কথা। রাজশাহীতে এটি মানা হচ্ছে না।

মহানগরীর রাণীবাজার এলাকার নতুন স্টোর (খাবারের দোকান) মালিক প্রশান্ত কুমার বলেন, ‘দোকানের নাম ইংরেজিতে লেখা ঠিক না। আমি কেনো ইংরেজিতে লেখবো? এই বাংলার জন্য বাঙালিকে রক্ত দিতে হয়েছে। আমি বাঙালি, বাংলা ভাষাকে ভালোবাসি বলেই দোকানের নাম বাংলায় লেখেছি।’

মহানগরীর বেশির ভাগ শোরুম বা ব্যাংকের বুথগুলোর নাম ইংরেজিতে লেখা। এছাড়া কিছু কিছু ব্যাংকে বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা চোখে পড়েছে। তবে শোরুমগুলোর সাইনবোর্ডে বাংলা লেখা নেই বললেই চলে। ইংরেজি ব্যবহারে এগিয়ে কোচিং সেন্টারগুলো। তাদের অবস্থা আরো করুণ। কোচিংগুলোর সাইনবোর্ডে বাংলার ব্যবহার নেই বললেই চলে।

গণকপাড়া তুলাপট্টি এলাকার বস্ত্রসহ বিবিধ পণ্যের দোকান ‘লেডিস্ পার্ক’। এর সাইনবোর্ড ইংরেজিতে লেখা। এবিষয়ে মালিক আশিকুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু আদালতের আদেশ আছে। অল্প সময়ের মধ্যে আমার দোকানের নাম বাংলায় লেখে নিবো।’

রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা বাংলা ভাষা পেয়েছি। তাই এই ভাষাকে মূল্যায়ন করতে হবে। কিন্তু আমাদের শহরের বেশির ভাগ দোকানের সাইনবোর্ডে ইংরেজিতে লেখা।

তিনি আরো বলেন, ইংরেজি লেখাটা বর্তমানে ফ্যাশন হয়ে গেছে। তাই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিকরা মনে করেন, ইংরেজি নাম হলে তার দোকান মডার্ন মনে হবে ক্রেতাদের কাছে। এ সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। মায়ের ভাষাকে সম্মান দিতে হবে।’

শিক্ষাবিদ ড. তসিকুল ইসলাম রাজা বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর প্রস্তাব গৃহিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য এখনো আমরা সেই কাঙ্খিত লক্ষ অর্জন করতে পারি নি। রাজধানী ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা শহরে এখনো নির্ভুলভাবে বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারি নি।

তিনি আরো বলেন, মহান ভাষা আন্দোলনের শহিদ বন্ধুদের রক্তের ঋণ পরিষদের জন্যই নির্ভুলভাবে বাংলার প্রচলন করা জরুরি। তাই সাইনবোর্ড বা নামফলকে বাংলা ভাষা চালুর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করর্পোরশেন সম্পূর্ণ ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড বিলবোর্ডগুলো অপসারণ অভিযান শুরু করে।