প্রচ্ছদ জাতীয় ভারতে পালিয়েছেন সম্রাটের সহযোগী চাঁদপুরের সেলিম খান!

ভারতে পালিয়েছেন সম্রাটের সহযোগী চাঁদপুরের সেলিম খান!

ক্যাসিনো গুরু যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটের সহযোগী চাঁদপুর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খান ওরফে চোরা সেলিমকে ধরতে অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব।

তবে র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে রাতেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছেন রিকশাচালক থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে ওঠা এই ইউপি চেয়ারম্যান।

সূত্র জানায়, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে চাঁদপুর জেলা সদর এলাকা এবং সদর উপজেলার লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে এ অভিযান চালানো হয়।

স্থানীয় একাধিক সূত্র জানিয়েছে, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা থেকেই র‌্যাবের একটি টিম দুদকের নজরদারিতে থাকা এই সেলিম খানকে গ্রেফতারের জন্য অভিযান চালিয়েছে।

কিন্তু র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে সেলিম খান আগেই আত্মগোপনে চলে যান বলে জানিয়েছে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকটি সূত্র।

এদিকে সেলিম খানের এলাকার লোকজনদের ধারণা, তিনি বর্ডার দিয়ে ভারতে পালিয়েছেন।

তারা বলেছেন, সর্বশেষ গত শনিবারও এলাকার লোকজন তাকে চাঁদপুরে দেখেছে। রোববার রাতে র্যা ব তাকে গ্রেফতার করার জন্য যাওয়ার পর থেকে তার হদিস মিলছে না। তারা বলছেন, দৈনিক যুগান্তরে যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাটের ছত্রছায়ায় তার উত্থান ও অবৈধ সম্পদ গড়ে তোলার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরই কোণঠাসা হয়ে পড়েন সেলিম খান।

নিজের লাইসেন্সকৃত অস্ত্র চাঁদপুর থানায় জমা দিয়ে পরবর্তী সময় জেলা প্রশাসক অফিসে গিয়ে ছুটিও নিয়েছেন তিনি। এর পর থেকে এলাকায় আর তাকে দেখা যায়নি।

এ বিষয়ে সেলিম খানের পরিবারসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের অনেকেই জানিয়েছেন, পত্রপত্রিকায় সংবাদ প্রকাশের কয়েক দিন পর থেকে তারা ইউপি চেয়ারম্যান সেলিম খানকে আর দেখেননি। ইউনিয়ন পরিষদ অফিসেও আসেননি।

এদিকে র্যা বের গণমাধ্যম শাখার সহকারী পরিচালক অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, চাঁদপুর র্যা ব ১১-এর আওতায় সেলিমকে গ্রেফতারে কোনো অভিযান চালানো হয়েছে কিনা তা আমরা নিশ্চিত হতে পারিনি।

তবে এলাকাবাসীর দেয়া এমন তথ্যের ভিত্তিতে চাঁদপুর ডিসি অফিসে যোগাযোগ করে জানা গেছে, সম্প্রতি সেলিম খান চেয়ারম্যানের দায়িত্ব থেকে দুই মাসের জন্য ছুটিতে থাকতে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়েছেন। সেখানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে অনির্বাচিত ইউপি মেম্বার মো. হোসেন বেপারির নাম প্রস্তাব করেছেন।

কে এই মো. হোসেন! জানা গেছে, এলাকায় সেলিম খানের রয়েছে ৩০০ মোটরসাইকেল নিয়ে একটি গুন্ডা বাহিনী। যাদের প্রধান কাজ প্রতিদিন মোটরসাইকেল নিয়ে চাঁদপুর চষে বেড়ানো ও সেলিম খানের প্রভাব বিস্তারে সহায়তা করা। আর মো. হোসেন সেই মোটরসাইকেল বাহিনীর প্রধান হিসেবে এলাকায় পরিচিত।

সেলিম খানের ক্ষমতাবলে মো. হোসেন নিজ ওয়ার্ডসহ লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগী স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন স্থানীয় জানান, গত কয়েক বছরে স্থানীয় ভিন্নমতধারীদের নানাভাবে নির্যাতন ও হয়রানি করেছেন এই মো. হোসেন।

সেলিম খানের অনুপস্থিতিতে তার সহযোগী সাঈদ মাস্টার, হোসেন ব্যাপারী এবং জামাতা নাজির খান সেলিম বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে জানা যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, চাঁদপুরের লক্ষ্মীপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম খানের বিরুদ্ধে অবৈধভাবে নদীদখল করে বালু ব্যবসা, এলাকার সাধারণ মানুষের জমি ও বসতবাড়ি দখল, অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম ছাড়াও সম্রাটের সহযোগী হয়ে ঢাকায় অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসা চালানোর অভিযোগ রয়েছে।

গত ১০ বছরে সেলিম আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে কয়েক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। দেশ-বিদেশে হাজার কোটি টাকার সম্পদ ও বাড়ি রয়েছে। তার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

চলমান ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেফতার ঢাকা মহানগর দক্ষিণের যুবলীগ সভাপতি ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাটকে রিমান্ড হেফাজতে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ক্যাসিনো ব্যবসায় নিজের সহযোগীদের নাম প্রকাশ করেন সম্রাট।

সেখানে চাঁদপুর সদরের ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম খানকে তার অন্যতম সহযোগী হিসেবে উল্লেখ করেন।

সূত্র জানায়, সম্রাটের হয়ে সেলিম খান পুরান ঢাকায় ফরাসগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব নিয়ন্ত্রণ করতেন। ওই ক্লাবের সভাপতিও হন তিনি। সম্রাটের সহযোগিতায় সভাপতি হয়ে ফরাসগঞ্জ ক্লাবে ক্যাসিনো খেলা, মাদকসহ নানা ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ চালু করে।

সম্রাট গ্রেফতারের পর ঢাকা ছেড়ে নিজ এলাকায় অবস্থান নেয় সেলিম। এ সময় তিনিই সম্রাট গ্রেফতারে র্যা বকে সহযোগিতা করেছেন বলে এলাকায় প্রচার করেন।

সরেজমিন অনুসন্ধানকালে সেই সময় তার ইউনিয়নের অনেক ভুক্তভোগী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, তাদের নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়ে নামমাত্র মূল্যে জমি রেজিস্ট্রি করে নিয়েছেন। যে জমির শতাংশ এক লাখ টাকা সে জমি তিনি ৫-১০ হাজার টাকায় নিচ্ছেন।

এলাকাবাসী জানিয়েছিলেন, চেয়ারম্যানের নিজের ইউনিয়নটি নদীর পাড়ে। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলে গরিব দুঃখীদের ফসলি জমি ও ভিটেবাড়ি নামমাত্র মূল্যে গ্রাস করে নিচ্ছেন। চাঁদপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের কথা বলে যাদের জমি নিয়েছেন, তাদের মধ্যে স্থানীয় সুকা কবিরাজের বাড়িসহ প্রায় ২৫ বাড়ির শতাধিক পরিবার নিঃস্ব হয়ে পড়েছে।

সুলতান খান, শাহালম খান, জাহাঙ্গীর, মুরাদ উকিলসহ অনেকের সম্পত্তি নামমাত্র মূল্যে কিনে তাদের উচ্ছেদ করার অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয়রা বলেন, তিনি চাইলে জমি দিতেই হবে। না দিলে পরিণতি হবে ভয়াবহ। চেয়ারম্যানের অত্যাচারের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ১০নং লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়নের এক বাসিন্দা।

তিনি বলেছিলেন, সাত-আট মাস আগে নামাজরত অবস্থায় আমার দুই ছেলেকে পিটিয়ে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল চেয়ারম্যানের ছেলে ও তার লোকজন। ঘটনার সময় সে (চেয়ারম্যান) উপস্থিত ছিল। বিষয়টি চাঁদপুরের এমন কোনো নেতা নেই যাকে আমি জানাইনি। কিন্তু কেউ কিছু করতে পারেনি। বর্তমানে চরম নিরাপত্তাহীনতায় আছি।

তিনি বলেন, আমার ৫৬ শতাংশ জমি জোর করে নিয়ে গেছে। এভাবে সে বহু মানুষের জমিদখল করেছে। কিছু বলতে গেলে চলে নির্যাতন।

অপরদিকে সম্রাটের সঙ্গে যোগ দিয়ে ঢাকা এবং আশপাশে নামে-বেনামে বিশাল সম্পদ গড়ে তুলেছেন। সম্রাট ছাড়াও যুবলীগের খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আরমান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর সাঈদসহ এ চক্রটির সঙ্গে মিলেমিশে নিজেকে অন্য প্রভাবশালীদের তালিকায় নিয়ে যান। তার সম্পদের ফিরিস্তিও বিশাল। নিজের মুখেই স্বীকার করেছেন কাকরাইলে তার চার তলা আলিশান বাড়ি রয়েছে।

এ ছাড়া ডেমরায় তার ৬তলা বাড়ি, নারায়ণগঞ্জের ভুইগড়, রাজধানীর হাতিরপুলসহ বিভিন্ন স্থানে বেনামি সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। সিনেমায় বিনিয়োগ রয়েছে কয়েক কোটি টাকা। চাঁদপুর শহরের কালীবাড়ির কাছে লাভলী স্টোরের জমি ২১ কোটি টাকা দিয়ে কিনেছেন বলে জানা গেছে।

তিনি ঢাকায় নিজের সাম্রাজ্য ধরে রাখতে সম্রাট, খালেদ, আরমান ও সাঈদ কমিশনারের সঙ্গে যোগ দিয়ে সিনেমার ব্যবসায় টাকা লগ্নি করেন। তার নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম শাপলা মিডিয়া।

আমি নেতা হব, চিটাগাইঙ্গা পোলা নোয়া খাইল্যা মাইয়া, ক্যাপ্টেন খান, শাহেনশাহ, প্রেম চোর, একটা প্রেম দরকার ও বিক্ষোভ ছবি তার টাকায় বানানো।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি ৭টি ছবির পেছনে কমপক্ষে ২৫ কোটি টাকা লগ্নি করেছেন। তবে সিনেমা সংশ্লিষ্টদের মতে, টাকার পরিমাণ আরও অনেক বেশি। তিনি বলেন, সিনেমা বানানোর পেছনে তিনি কোনো টাকা বিনিয়োগ করেননি।

এদিকে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের বিপুল সম্পদের বর্ণনা শুনে বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি জানিয়েছিলেন, চেয়ারম্যান সেলিমের সম্পদের বিবরণ শুনে মনে হয়েছে বড় ধরনের অনিয়মের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদ আহরণের একটি দৃষ্টান্ত। এটা পরিষ্কারভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি। তদন্তের বিষয়টি দুর্নীতি দমন কমিশনের এখতিয়ার হয়ে যায়। কাজেই আমরা আশা করব, তার ব্যাপারে সঠিক তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। সূত্র : যুগান্তর