প্রচ্ছদ বিশেষ প্রতিবেদন বউ হওয়াই পেশা

বউ হওয়াই পেশা

খুলনার বাসিন্দা আবদুর রাজ্জাক। যেতে চান বিদেশে। যোগাযোগ করলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। তারা নতুন পরামর্শ দিল রাজ্জাককে। তাদের ম্যারেজ মিডিয়া আছে। যে দেশে যেতে চান, সেই দেশেই থাকেন এমন একজন মেয়ে আছে তাদের কাছে। তাকে বিয়ে করলেই যাওয়াটা সহজ হবে। এ জন্য টাকা লাগবে পাঁচ লাখ। আবদুর রাজ্জাকের কাছে প্রস্তাবটি ভালো লাগে। তিনি রাজি হন। কয়েক দিনের মধ্যে একজন মেয়েও দেখানো হয় রাজ্জাককে। পরে নানা কথা বলে ধাপে ধাপে আড়াই লাখ টাকা নেওয়া হয় তার কাছ থেকে। শেষে রাজ্জাক বুঝতে পারেন, প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন তিনি। পুলিশকে জানান তিনি।

রাজ্জাকের অভিযোগ পেয়ে ম্যারেজ মিডিয়াতে অভিযান চালায় পুলিশ। রাজধানীর শ্যামলী ও আফতাবনগরে তাদের দুটি শাখা। দুটি কার্যালয়েই যায় পুলিশ। আটক হয় মোট আট নারী। ওদের পেশা বউ সেজে প্রতারণা। কখনো গ্রাম্য বধূ, কখনো ধার্মিক স্ত্রী, আবার কখনো প্রবাসী কনের ছদ্মবেশে বাসরঘর করে। সুযোগ বুঝে স্বামীর সবকিছু লুটে নিয়ে লাপাত্তা। ভোর হওয়ার আগেই। এদের একজনের নাম নাজমা ওয়াহিদা ইসলাম রোজী। শিক্ষিত, স্মার্ট, সুদর্শনা। এমএ শেষ করেছেন ঢাকার একটি মহিলা কলেজ থেকে। রোজী পেশাদার পাত্রী হিসেবে পাত্রদের প্রতারিত করে আসছেন দীর্ঘদিন। পাত্রের কাছ থেকে যা পাওয়া যায়, রোজী পান তার ১০ শতাংশ। বাকি সব ম্যারেজ মিডিয়ার। পুলিশ জানায়, এরা প্রতিদিনই কারও না কারও বউ সেজে প্রতারণার ফাঁদ পেতে বসে থাকে। দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে অপরূপ সাজে বসে থাকে তারা। প্রবাসী, ধনীর দুলালী, অভিজাত এলাকার গাড়ি-বাড়ির মালিক ও ডিভোর্সি থেকে শুরু করে ধার্মিক হয়েও প্রতারণার ফাঁদ পাতে। বিদেশ যেতে আগ্রহীরা যোগাযোগ করলে দেখানো হয় ভিসা লাগানো পাসপোর্ট ছাড়াও অপরূপা পাত্রীর ছবি। চাইলে স্বশরীরে হাজির করা হয়।

রাজ্জাকের মতো প্রতারণার শিকার হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এমন প্রতারণার বাণিজ্য থেমে নেই। অসংখ্য নারী-পুরুষ সর্বস্ব খুইয়েছেন বিয়ে প্রতারণার কবলে পড়ে। প্রবাসী পাত্র-পাত্রীদের বিয়ে কেন্দ্র করে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। পরবর্তী সময়ে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে অধিকাংশ পাত্র-পাত্রীই প্রকৃতপক্ষে প্রবাসী নন। দেশ ছেড়ে বিদেশ পর্যন্ত এই প্রতারক চক্রের নেটওয়ার্ক বিস্তৃত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের মুখে ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়ার ব্যবসা অনেকটা কমেছে। হালে চলছে ফেসবুক, মোবাইল ফোন আর পরিচিতজনদের মাধ্যমে বিয়ে নিয়ে প্রতারণার সব অভিনব ঘটনা। এমন প্রতারণার কবলে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। অনেক পাত্র-পাত্রী ও তাদের পরিবার-পরিজনকে জেলের ঘানি পর্যন্ত টানতে হচ্ছে। বিয়ে নিয়ে প্রতারণার বেশ কয়েকটি ঘটনার তদন্তে গিয়ে এমন তথ্য পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ ও র‌্যাব জানায়, গত কয়েক বছরে অন্তত পাঁচ হাজার অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। একেকটি অভিযোগ একেরটির চেয়ে গুরুতর। অনেক ঘটনার রহস্য উদ্ঘাটন করা সম্ভব হয়েছে। উদ্ঘাটিত ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বিয়ে নিয়ে প্রতারিত হওয়ার মূল কারণ লোভ। এমন সুযোগটিকে কাজে লাগায় চক্রের সদস্যরা। তারা পাত্র বা পাত্রী প্রবাসী বলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে প্রচার চালায়। আর পাত্র পক্ষ প্রবাসী পাত্রীর কথা শুনে বিদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস ও কর্মস্থানের আশায় বিয়েতে রাজি হয়। আর তখনই নানাভাবে প্রতারণার কবলে পড়ে। চক্রটি পাত্র পক্ষের কাছ থেকে নানা কৌশলে বিদেশ পাঠিয়ে দেওয়ার নাম করে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। এই চক্রটির সঙ্গে মানব পাচারকারী চক্রেরও যোগাযোগ আছে। ঠিক একইভাবে প্রবাসী পাত্রের কাছে মেয়ে বিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে চান অভিভাবকরা। আর তাতেই অভিভাবক ও পাত্রীরা পড়েন প্রতারণার কবলে। পাত্রী পক্ষকে তড়িঘড়ি করে বিয়ের আয়োজন করতে বলে প্রতারক চক্র। বিয়ের পরেই পাত্রীকে বিদেশে নিয়ে যাওয়ার নাম করে মোটা অঙ্কের টাকা নানা কৌশলে হাতিয়ে নেয় চক্রটি। চক্রগুলো এতটাই বিশাল যে, বিদেশেও তাদের নেটওয়ার্ক রয়েছে। তারা ফেসবুক ছাড়াও পরিচিতজনদের মাধ্যমে বিয়ের নামে প্রতারণা করে। এসব ক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রীর সঙ্গে বিদেশে চাকরি করা প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিয়ের কথা বলে ওইসব পাত্র-পাত্রীকে দেশে থাকা প্রতারক চক্রের কাছে পাঠায়। তারাই পাত্র-পাত্রীকে বিয়ের নামে প্রতারণার কবলে ফেলে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। অনেক সময় অপহরণের ঘটনাও ঘটায়। র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, এমন প্রতারণার নেপথ্যে রয়েছে ম্যারেজ মিডিয়া হাউস। গত কয়েক বছরে বহু ভুয়া ম্যারেজ মিডিয়াকে জেল-জরিমানা করা হয়েছে। তারপরেও বিয়ে নিয়ে প্রতারণা থেমে নেই। অনেক ম্যারেজ মিডিয়া গোপনে ও ফেসবুকের মাধ্যমে তৎপরতা চালাচ্ছে। আগের তুলনায় বিয়ে নিয়ে প্রতারণার ঘটনা অনেক কমে এলেও পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। এমন প্রতারণার কবল থেকে রক্ষা পেতে সবচেয়ে বেশি জরুরি সচেতনতা। পাত্র বা পাত্রী পক্ষকে অবশ্যই জেনেশুনে বিয়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা ও খোঁজখবর নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় প্রতারিত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, ‘ঘটকালি সব সময়ই ছিল। বিষয়টির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করেছে ম্যারেজ মিডিয়াগুলো। আধুনিক জীবনের নানা জটিলতার কারণে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো বেশ প্রয়োজনীয়ই হয়ে উঠেছে। এই প্রতারণা রোধ করতেই হবে। আমাদের নিজের ওপর পড়ছে না বলে হয়তো আমরা কিছু বলছি না। কিন্তু বিপদে পড়িনি বলে চুপ করে থাকলে এক সময় হয়তো আমরাও বিপাকে পড়ব।’