প্রচ্ছদ বিশেষ প্রতিবেদন প্রিয়াঙ্কার দোভাষী মাহবুবা

প্রিয়াঙ্কার দোভাষী মাহবুবা

রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে টানা চার দিন প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে দোভাষীর কাজ করেছেন মাহবুবা আক্তার। ছবি: খালেদ সরকার

রোহিঙ্গা শিশুদের দেখতে ইউনিসেফের একজন শুভেচ্ছাদূত আসছেন কক্সবাজারে। কিন্তু তিনি কে? সপ্তাহখানেক আগেও এই তথ্যটুকু জানতেন না মাহবুবা আক্তার। যেমন জানতেন না, আদতে দোভাষীর কাজটি তিনিই করছেন। কারণ, ইউনিসেফ তাদের বিশেষ দূতের জন্য দোভাষী বাছাইয়ের চূড়ান্ত তালিকায় তখনো আরও একজনকে রেখেছেন। এমন সব দোলাচলের মধ্যে ২০ মে রাতে মাহবুবাকে জানানো হলো, তিনিই দোভাষী হিসেবে কাজ করছেন। আর কাজ করবেন ইউনিসেফের শুভেচ্ছাদূত ও বলিউড তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে। কাজের নিশ্চয়তায় তিনি খুশি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু যে মানুষটির হয়ে তিনি দোভাষীর কাজ করবেন, তার নাম শুনে তো ভিরমি খাওয়ার জোগাড়!

মাহবুবা আক্তার বলছিলেন, ‘আমি তখন কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, একটি চিৎকার দিই। তবে ফোনে কথা বলছিলাম বলে কিছুক্ষণের মধ্যে নিজেকে সামলে নিলাম।’

২৪ মে। ততক্ষণে কক্সবাজার ছেড়েছেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। আমরা অভিজ্ঞতা শুনছিলাম মাহবুবা আক্তারের। কক্সবাজার সরকারি কলেজের হিসাববিজ্ঞান (স্নাতক) বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রীর চোখে-মুখে তখনো টানা চার দিন প্রিয় তারকার সঙ্গে সময় কাটানোর বিস্ময়। নভেম্বর থেকে ইউনিসেফের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে অনেক বিশিষ্ট মানুষের পাশে থেকে ভাষা বদলের কাজ করেছেন। তবে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে থাকার সময়টুকু জীবনের অনন্য ঘটনা তাঁর কাছে।

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে মাহবুবার সেলফি

২১ মে দুপুর ১২টায় ইউনিসেফের গাড়ি মাহবুবাকে নিয়ে চলল উখিয়ার হোটেল রয়েল টিউলিপে। হোটেলে খুব একটা সময় অপেক্ষা করতে হলো না তাঁকে। চলে এলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া। অবাক, বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে থাকলেন প্রিয় তারকার দিকে। দুপুরে প্রথম দেখায় হাত বাড়িয়ে দেওয়ার পর প্রিয়াঙ্কা চোপড়া মাহবুবাকে বললেন, ‘হ্যালো’। দু–এক কথার পর প্রশ্ন করলেন, ‘হিন্দি বোঝো?’ ‘বাংলাদেশের মানুষ বোঝে?’ মাহবুবা প্রিয়াঙ্কাকে জানালেন, ‘বেশির ভাগ মানুষই বোঝে, অনেকে বলতেও পারেন।’ বলিউড তারকার এমন সাবলীল কথাবার্তায় কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহবুবার জড়তা কেটে গেল। পরিচিত মানুষের মতো কথা হলো।

সেদিন এভাবেই শুরু হয়েছিল মাহবুবা আক্তারের দোভাষীর কাজ। মাহবুবা বাংলা, ইংরেজি এবং স্থানীয় ভাষা জানেন। এরপরের চার দিন প্রিয়াঙ্কা যখন যেখানে গেছেন, তিনি থাকতেন সঙ্গে। তবে সফরের সময় কখন, কোথায় প্রিয়াঙ্কা যাচ্ছেন, নামার আগে জানতেন না মাহবুবা। এমন গোপনীয়তার কারণ মানুষের জটলা এড়ানো। তবু ভিড় হতো। প্রথম দিন এমনও হয়েছে, রোহিঙ্গা শিশুদের সঙ্গে দেখাও করতে পারছেন না প্রিয়াঙ্কা। এ জন্য নাকি খুব মন খারাপ করতেন বলিউড অভিনেত্রী।

প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে চার দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মাহবুবা বললেন, ‘তাঁকে দেখেছি, খুব মমতার সঙ্গে শিশুদের কাছে টেনে নিচ্ছেন, আদর করছেন, খেলেছেন, নাচছেন। ছবি তুলতে ডাকলে বাচ্চারা হুড়মুড় করে তার গায়ে গিয়ে উঠত। তখন এ বিষয়টি তাকে উপভোগ করতে দেখেছি। যেন ওদেরই একজন তিনি। কত সাবলীলভাবে মিশেছেন।’ প্রিয়াঙ্কার আরও একটি বিষয় মাহবুবাকে ছুঁয়ে গেছে। সেটা হলো রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের যন্ত্রণা তাঁকে ছুঁয়ে গেলেও তিনি মেকি আবেগ দেখাননি। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। মাহবুবার ভাষায়, ‘তাঁকে বারবার বিড়বিড় করে বলতে শুনেছি, এদের জীবনে এসব কী হলো!’

বিদায়ের আগে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সেলফি তোলার স্মৃতিটিও আনন্দ দেয় মাহবুবাকে। তিনি যেমনটি বলছিলেন, ‘চার দিন কখনো বলিনি, আপনার সঙ্গে ছবি তুলতে চাই। যদিও পছন্দের তারকার সঙ্গে স্মৃতি ধরে রাখার ইচ্ছেটা বারবার তাড়া করছিল। কিন্তু দায়িত্বের মধ্যে আবেগ থাকতে নেই!’ তবে শেষ দিন সেলফি তোলার সুযোগ হলো মাহবুবার। সেটাও অনেকটা কাকতালীয়। মাহবুবা সেই চমকজাগানিয়া মুহূর্তের কথা বলছিলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবির ছাড়ার সময় একজন মেয়ে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সেলফি তুলছিলেন। এ সময় আমার মুঠোফোন দেখিয়ে নিজে থেকেই বললেন, ‘আপনা তোলো। জলদি গাড়ি মে উঠনা হ্যায়।’ আমি বিস্ময়ভরা দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আমাকে আবার বললেন, ‘তাড়াতাড়ি সেলফি তোলো।’ কাঁপা হাতে সেলফিটা তুললাম। যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘অনেক ভালো কাজ করেছ। ভালো থেকো।’

প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সুখস্মৃতির ফাঁকে মাহবুবা আক্তারের জীবনকথাও শোনা হলো। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ। বাবা স্থানীয় একটি ফিলিং স্টেশনে কাজ করেন আর মা গৃহিণী। গত সেপ্টেম্বরে কক্সবাজার লজিটিকস নামের একটি সংস্থার মাধ্যমে মার্কিন একটি সংস্থার জন্য দোভাষীর কাজ শুরু করেন মাহবুবা। একপর্যায়ে যোগাযোগ হয় ইউনিসেফের সঙ্গে। সংস্থাটির জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা কক্সবাজার এলেই ডাক পড়ত তাঁর। প্রথমে পাঠানো হয় মার্কিন সংস্থা এমটিআইতে। এ সময় সেপ্টেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ছুটির দিনগুলোতে আবার যুক্ত হতে শুরু করেন ইউনিসেফের সঙ্গে। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তিন নারী ম্যারিয়েড ম্যাগুয়ার, শিরিন এবাদি ও তাওয়াক্কল কারমান, যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরিস জনসনসহ বেশ কয়েকজন উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কাজ করেছেন মাহবুবা।