প্রচ্ছদ আর্ন্তজাতিক নিউ ইয়র্কের বাস টার্মিনালে হামলাকারী বাংলাদেশি আকায়েদের বিচার শুরু

নিউ ইয়র্কের বাস টার্মিনালে হামলাকারী বাংলাদেশি আকায়েদের বিচার শুরু

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটন পোর্ট অথরিটি বাস টার্মিনালে বোমা হামলাকারী হিসেবে অভিযুক্ত ও আটক বাংলাদেশি আকায়েদ উল্লাহর বিচার শুরু হয়েছে। ২০১৭ সালের ১১ ডিসেম্বর সকালে টাইমস স্কয়ারের কাছে পোর্ট অথরিটি সাবওয়ে স্টেশনের কাছে পাইপ বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিজেকে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টার অভিযোগ এনেছে কর্তৃপক্ষ।

স্থানীয় সময় মঙ্গলবার ম্যানহাটনের আদালতে আকায়েদের আইনজীবীরা জানিয়েছেন, জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারা তাকে একজন হতাশ ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

আদালতে দেওয়া সূচনা বক্তব্যে আকায়েদ উল্লাহর আইনজীবী ওই বিস্ফোরণে তার মক্কেলের জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেননি। তবে আকায়েদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসকে সমর্থনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে তা তুলে নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

আকায়েদ উল্লাহর আইনজীবী জুলিয়া গাটো বলেন, এটি আমাদের দেশে একটি বিদেশি সন্ত্রাসী সংগঠনের তৎপরতা সংক্রান্ত মামলা নয়। হতাশ আকায়েদ উল্লাহ দুনিয়াজুড়ে মুসলিমদের প্রতি বাজে আচরণ সম্পর্কে ইন্টারনেটে বিকৃত টেক্সট বা মেসেজ পেয়েছিলেন বলে জানান জুলিয়া গাটো।

যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃপক্ষ অবশ্য আকায়েদ উল্লাহর চালানো ওই বিস্ফোরণকে সন্ত্রাসী হামলা হিসেবে দেখছে। জিজ্ঞাসাবাদে সে নিজেও স্বীকার করেছে যে, ‘আইএসের জন্যই আমি এ কাজ করেছি।’ আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা জিজ্ঞাসাবাদে আকায়েদের দেওয়া এ স্বীকারোক্তি তুলে ধরেন।

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রেবেকাহ দোনালেস্কি বলেন, আকায়েদ উল্লাহর কম্পিউটার তল্লাশি করে সেখানে আইএসের প্রপাগান্ডা সামগ্রী পাওয়া গেছে। সেখানে বলা হয়েছে, আইএসে যোগ দিতে ভ্রমণে যেতে সক্ষম নয় এমন ব্যক্তিরা যেন তাদের বসবাসের স্থানে একাকী হামলা চালায়। এমনকি হামলা চালানোর আগে সে ফেসবুকে বলেছিল, ‘ট্রাম্প, তুমি তোমার জাতিকে রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছ।’

ছয় বছর আগে বাংলাদেশে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যান আকায়েদ উল্লাহ। আকায়েদ উল্লাহর নিউ ইয়র্ক শহরে ট্যাক্সি ও লিমোজিন গাড়ি চালানোর লাইসেন্স ছিল। ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ওই লাইসেন্সের মেয়াদ ছিল। ২০১৫ সালের মে মাসের পর ওই লাইসেন্স আর নবায়ন করা হয়নি। তবে শহরের ইয়েলো ট্যাক্সি বা উবার চালানোর লাইসেন্স তার ছিল না। চাচার মাধ্যমে ভিসা পেয়েছিলেন আকায়েদ। তার চাচা ডিভি লটারি জিতে মার্কিন নাগরিকত্ব পান। ম্যানহাটনে হামলার পরপরই আকায়েদকে গ্রেফতার করা হয়। বেলভিউ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয় তাকে। তখনও তদন্তকাজ চলছিল। সে সময়ই ৯ ভোল্টের ব্যাটারির খোঁজ মেলে তার পকেটে। তার জ্যাকেটে পাওয়া যায় দুটি প্লাস্টিক জিপ, লোহার পাইপের অংশ এবং ক্রিসমাস ট্রি লাইট। নিউ ইয়র্কের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ওই সময় জানিয়েছিলেন, কর্মস্থলে বিস্ফোরকটি তৈরি করেছিলেন আকায়েদ উল্লাহ নিজেই। এ ঘটনায় চারজন আহত হয়েছেন। ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আকায়েদকে আটক করেছে পুলিশ। ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে সে ওই হামলা চালিয়ে থাকতে পারেন ধারণা করেছিল পুলিশ।

আকায়েদ কর্মস্থলে বোমাটি তৈরি করেছিলেন বলে প্রাথমিক তদন্তে নিশ্চিত হয়েছিল পুলিশ। তিনি নিজেও তা স্বীকার করেছেন। যদিও বাস টার্মিনালে হামলার পর পরই পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, কারিগরি ত্রুটির কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে কিনা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তের পর তা নাকচ করা হয়।

আকায়েদ নিজেই পুলিশকে জানান, মার্কিন সরকারের মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণেই তার হামলা। উদ্দেশ্য ছিল আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া। এজন্যই কর্মদিবসে হামলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ফেডারেল গোয়েন্দারা দাবি করেন, ২০১৪ সালে আকায়েদ আইএস দ্বারা অনুপ্রাণিত হতে শুরু করেন। আইএস থেকে ভিডিও বার্তায় জানানো হয়, যেই সমর্থকরা দেশ পাড়ি দিয়ে আইএস যোগ দিতে পারছেন না তারা যেন নিজ দেশেই হামলা চালায়। এই ভিডিওতে অনুপ্রাণিত হয়ে আকায়েদ ইন্টারনেটে খুঁজতে শুরু করেন কিভাবে বোমা তৈরি করা যায়।

আকায়েদের বাড়ি থেকে অনেকগুলো পাইপ, ক্রিসমাস ট্রি লাইট ও স্ক্রু পাওয়া গেছে। অনেকগুলো হাতে লেখা নোট ছিলো। সেখানে লেখা। ‘আমেরিকা নিজের আগুনেই মরবে তুমি।’

ম্যানহাটনের ওই হামলাকে যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসন নীতির ফলাফল হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন অভিবাসন নীতিতে আত্মীয় স্বজনের বদৌলতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের সুযোগ রয়েছে। ওই হামলাকে কেন্দ্র করে ট্রাম্প কংগ্রেসকে সেই সুযোগ পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানিয়েছিলেন।

কংগ্রেসের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘পরিবারভুক্তদের অভিবাসী হওয়ার সুযোগ নিয়েই (ফ্যামিলি চেইন নীতি) এই সন্দেহভাজন জঙ্গি যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে সক্ষম হয়েছে। এটা আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। আমেরিকার অবশ্যই অভিবাসন নীতিকে সুরক্ষিত করা উচিত। এই নীতির কারণেই খুবই ভয়াবহ ব্যক্তিরা নির্বিচারে যুক্তরাষ্ট্র প্রবেশে সক্ষম হয়।’

আকায়েদের প্রতিবেশীরা যা বলেছেন

আকায়েদের প্রতিবেশীরা জানান, আকায়েদ ও তার পরিবার যে বাড়িতে থাকেন, ঠিক তার পাশেই থাকেন অ্যালান বুতরিকো। আকায়েদ থাকতেন ভূগর্ভস্থ (বেসমেন্ট) কক্ষে। তার বোন থাকতেন দোতলায়। তার ভাইও থাকতেন একই ভবনে। বুতরিকো বলেন, ‘গত দুই রাত ধরে আকায়েদের বাড়ি থেকে মারামারি, চিৎকার ও কান্নার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল।’

বুতরিকো বলেন, ‘আমার ভাড়াটিয়ারা জানিয়েছেন, গত দুই রাত ধরেই এমন চলেছে। তারা বলেছেন যে, কান্না ও গোঙানোর শব্দ শুনতে পেয়েছেন। তবে কী হয়েছে বুঝতে পারেননি। পুলিশেও খবর দেওয়া হয়নি।’

অ্যালান আরো জানান, বন্ধুসুলভ ছিলেন না আকায়েদ। তিনি বলেন, ‘তিনি একেবারেই বন্ধুসুলভ ছিলেন না। তার পরিবার একেবারেই অর্ন্তমুখী স্বভাবের। কারো সঙ্গেই খুব একটা কথা বলতেন না। তারা কেবল এখানে থাকতেন, ব্যস এটুকুই।’

নিউ ইয়র্কের মেয়র বিল ডে ব্লাসিও বলেছেন, ‘একটি সন্ত্রাসী হামলার চেষ্টা হয়েছিল। ভাগ্য ভালো যে সন্দেহভাজন ব্যক্তিটি সফল হতে পারেনি।’ ঘটনাস্থলের কাছাকাছি থাকা ৬২ বছর বয়সী আন্দ্রে রদ্রিগুয়েজ নিউ ইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, ‘আমি ঘূর্ণায়মান দরজার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে বিস্ফোরণের মতো শব্দ শোনা গেল এবং সবাই দৌড়াদৌড়ি শুরু করল।’

৫১ বছর বয়সী আলিসজা ওল্ডউস্কি বলেছেন, ‘যখন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে তখন আমি একটি রেস্টুরেন্টে বসে খাবার খাচ্ছিলাম। আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্কিত এক নারী রাস্তায় পড়ে গেলেও তাকে ওঠানোর জন্য কেউ থামল না। সবাই দৌড়াচ্ছিল। একসময় সব কিছু স্তিমিত হলো।’

আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বলছে, গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে আবেগতাড়িত হয়েই আকায়েদ এ ধরনের হামলা চালাতে পারেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তিনি জানিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলের ‘অনুপ্রবেশ’ তিনি মেনে নিতে পারেননি। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু ব্যাখ্যা করেননি তিনি।

অন্যদিকে, জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে আকায়েদের সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না- সে বিষয়টি এখনো স্পষ্ট হয়নি। কিছু সংবাদমাধ্যম এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশ করেছে।

নিউ ইয়র্কের পুলিশ কমিশনার জেমস ও’নিল বলেছেন, ‘আকায়েদের কাছ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পাওয়া গেছে।’ কিন্তু সে ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে চাননি তিনি।