প্রচ্ছদ বিশেষ প্রতিবেদন নতুন লোক দেখলেই ছুটে আসেন দালাল

নতুন লোক দেখলেই ছুটে আসেন দালাল

আজ মঙ্গলবার সকাল ১০টা। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) কার্যালয়ের সামনে এসে থামল একটি ব্যক্তিগত গাড়ি। সঙ্গে সঙ্গেই একটি জটলা থেকে ৩-৪ জন লোক ছুটে আসেন সেই গাড়ির চালকের কাছে। কিছুক্ষণ কথা বলার পর আবার আগের জায়গায় চলে যান ওই ব্যক্তিরা। চালক গাড়িটি বিআরটিএ কার্যালয়ের এক পাশে রেখে দেন।

গাড়ির কাছে গিয়ে চালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তাঁর নাম নুরুজ্জামান। তিনিই গাড়ির মালিক। পাশাপাশি ভাড়ায় গাড়ি চালান। ওই লোকেরা তাঁর কাছে এসে জানতে চান বিআরটিএতে কী কাজে এসেছেন তিনি। নুরুজ্জামান তাঁদের বলেন তিনি গাড়ির ফিটনেসের কাগজ নিতে এসেছেন। এ সময় তাঁকে প্রস্তাব দেওয়া হয় বিআরটিএতে যে খরচ আছে তার চেয়ে দুই-তিন হাজার টাকা দিলেই তাঁর কাগজ হয়ে যাবে। এ জন্য তাঁকে মাত্র আধা ঘণ্টা বসতে হবে। তাঁদের কথায় রাজি হয়ে নুরুজ্জামান কাগজ করাতে দিয়েছেন।

নুরুজ্জামান বলেন, ১ হাজার ৩০০ সিসি গাড়ির জন্য বিআরটিএকে দিতে হয় ১৮ হাজার টাকা। ১ হাজার ৫০০ সিসির গাড়ির জন্য দিতে হয় ২৩ হাজার টাকা। এই খরচের বাইরে ২ থেকে ৩ হাজার টাকা বেশি দিলেই দালালেরা আধা ঘণ্টার মধ্যে কাগজ এনে দেন। তবে প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে পেরে বেশি কিছু বলতে রাজি হননি নুরুজ্জামান।

বিআরটিএ কার্যালয়ে দালালদের দৌরাত্ম্যের ঘটনা হরহামেশাই দেখা যায়। তবে কয়েক দিন ধরে এটি অনেক গুণ বেড়ে গেছে। দালালেরাও টাকার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছেন। নিরাপদ সড়কের দাবি ও রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থীর বাসচাপায় মৃত্যুর বিচারসহ ৯ দফা দাবিতে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা গাড়ি ও মোটরসাইকেলের চালদের লাইসেন্স পরীক্ষা করে। এতে লাইসেন্স না থাকা অনেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। এসব কারণে সম্প্রতি নতুন লাইসেন্স, গাড়ির ফিটনেস নবায়ন করার ধুম পড়েছে বিআরটিএতে।

বিআরটিএতে দেখা গেছে, মূল ফটকের বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে তিন-চারজনের ছোট ছোট জটলা। কার্যালয়ের ভেতরে বিভিন্ন কক্ষের আশপাশ, ব্যাংক, বাদামতলা সর্বত্র দালালেরা তৎপর। মূল ফটকের পাশে স্ট্যাম্প, ফটোকপির দোকানগুলো তাদের মূল আস্তানা। নতুন কেউ এখানে এলেই তাঁদের কাজ করার প্রস্তাব দেন দালালেরা।

আলাল নামের এক দালালের সঙ্গে কথা হয়। বিভিন্ন লোককে কাজ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছিলেন তিনি। ড্রাইভিং লাইসেন্স করতে কত টাকা লাগবে? জানতে চাইলে আলাল বলেন, লাইসেন্স করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। খরচ পড়বে ৯ হাজার টাকা। এত টাকা কেন লাগবে? জানতে চাইলে বলেন, ভেতরের লোককে লাইসেন্স ফিসহ দিতে হবে ৭ হাজার টাকা। আর দুই হাজার আমার থাকবে। দাম শুনে তাঁকে কিছুটা কমাতে বললে তিনি বলেন, ‘এক রেট ৮ হাজার টাকা। লাগলে বইলেন। আর দরদাম কইরেন না।’

বিআরটিএ থেকে জানা গেছে, ড্রাইভিং লাইসেন্স করার সরকারি ফি ৩ হাজার ৫০০ টাকা। পুরো প্রক্রিয়া শেষ হতে ছয়-সাত মাস সময় লাগে। শিক্ষানবিশ ড্রাইভিং লাইসেন্স করার ছয় মাস পর ব্যবহারিক পরীক্ষার তারিখ দেওয়া হয়।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বিআরটিএ কার্যালয়ে লাইসেন্সের টাকা জমা দেওয়ার দীর্ঘ লাইন পড়ে। টাকা জমা দিতে তিন-চার ঘণ্টাও সময় লেগে যায়। এই সুযোগে কিছু দালাল সকালে এসে লাইনে দাঁড়ান। পরে বিআরটিএতে আসা মানুষজনের কাছে সেই লাইন হস্তান্তর করার বিনিময়ে টাকা নেন। অনেকে ভোগান্তি এড়াতে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকায় লাইন কিনে নেন।

লাইসেন্সের জন্য টাকা জমা দেওয়ার লাইনে গিয়ে কথা হয় রতন নামের একজনের সঙ্গে। লাইনে দাঁড়ানোর কিছুক্ষণ আগেও তাঁকে বিআরটিএ কার্যালয়ের বাইরে ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেছে। কার টাকা জমা দিতে এসেছেন? জানতে চাইলে রতন বলেন, তিনি তাঁর মালিকের টাকা জমা দিতে এসেছেন। মালিক কোথায়? জানতে চাইলে তিনি বলেন, মালিক বাইরে আছে। পরে বলেন, বাসায় আছেন। কথা বলার সময় তিনি কাঁপছিলেন। পাশ থেকে একজন বললেন, এরা আসলে বিআরটিএর নিয়মিত দালাল। টাকার বিনিময়ে অন্যের কাজ করে দেন।

লাইনে দাঁড়িয়েছিলেন মো. শাহীন নামের একজন। কার কাগজ জমা দিচ্ছেন? জানতে চাইলে তিনিও বলেন, ‘আমার কাগজ না। আমার ওস্তাদের কাগজ। ওস্তাদের নাম দুলাল। তিনি গাড়ি চালান। তাঁর সময় নাই তাই আমারে পাঠাইছে।’

বিআরটিএ কার্যালয়ে ঘুরে জানা গেল, দালালের আনাগোনা বেশি হওয়ার একটি বড় কারণ হচ্ছে এখন মানুষ বিআরটিএতে লাইসেন্সের জন্য বেশি ভিড় করছেন। ট্রাফিক সপ্তাহ ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা চালকের লাইসেন্স ও গাড়ির কাগজপত্র পরীক্ষা শুরু করার পর এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।

ধানমন্ডি থেকে এসেছেন মো. এনামুল। তিনি বলেন, আগে শিক্ষানবিশ লাইসেন্স ছিল। সেটির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাই লাইসেন্সের জন্য এসেছি। আগে কেন করেননি? এ কথা বলতেই কিছুটা লজ্জা পেয়ে তিনি বললেন, ‘কয়েক দিন আগে রাস্তায় স্কুলের শিক্ষার্থীরা আটকাইছে। এরপর কয়েক দিন মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ রেখেছিলাম। রাস্তার পরিস্থিতি খারাপ থাকায় লাইসেন্সের জন্য বিআরটিএতে আসতে পারিনি। আজ এসেছি। টাকা জমা দিলাম। লাইসেন্স না পাওয়া পর্যন্ত মোটরসাইকেল চালাব না।’

একই অবস্থা সাভারের বাসিন্দা মো. হুমায়ুনের। তিনি কল্যাণপুরে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তাঁর লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছে। এত দিন পুরোনো লাইসেন্স দিয়ে চালিয়েছেন। সম্প্রতি শিক্ষার্থীরা লাইসেন্স যাচাই করা শুরু করার পর তিনি লাইসেন্সের নবায়ন করতে এসেছেন। তিনি বলেন, ‘শিশুরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছে। আর লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালাব না।’

জানতে চাইলে বিআরটিএর উপপরিচালক মাসুদ আলম বলেন, ‘আগের তুলনায় গত কয়েক দিনে কাজের চাপ বেড়ে গেছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর লোকজনের চাপ প্রচুর বেড়েছে। মানুষ আরও সচেতন হয়ে বিআরটিএতে আসছেন। আমরা আগে সকাল ৯ টা থেকে ৫টা পর্যন্ত কাজ করতাম। আর সপ্তাহে শুক্র, শনিবার বন্ধ রাখতাম। এখন শনিবারেও বিআরটিএ অফিস খোলা। আর সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ চালানোর আদেশ হয়েছে। দালালদের হাত থেকে রক্ষার জন্য বিআরটিএ অফিসের বিভিন্ন স্থানে সচেতনতামূলক পোস্টার লাগানো হয়েছে। এ ছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে নিয়মিত দালালদের সাজা দেওয়া হচ্ছে।’