ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বে বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেক দিন আগেই।
বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের ভেতরে দুটি গ্রুপের দ্বন্দ্ব বেশ কিছুদিন ধরেই চলে আসছিল। কিন্তু ১ ডিসেম্বর, শনিবার সেই দ্বন্দ্ব সহিংস রূপ নেয়। এই দ্বন্দ্বের কেন্দ্রে আছেন তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা দিল্লির মাওলানা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভি। অভ্যন্তরীণ এই কোন্দলের কারণেই ঢাকার টঙ্গীতে এবার বিশ্ব ইজতেমা হতে পারেনি।
বিবিসি বাংলার খবরে বলা হয়, তাবলিগ জামাতের একটি গ্রুপ আসছে বছরের ১১ জানুয়ারি থেকে ইজতেমা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গত মাসে তাবলিগ জামাতের দুই গ্রুপকে নিয়ে বৈঠক করেন, যেখানে ওই তারিখে ইজতেমা না করার সিদ্ধান্ত হয়।
সাদ কান্দলভি কী বলেছেন, যা নিয়ে এই বিভক্তি?
বেশ কিছুদিন ধরেই সাদ কান্ধলভি তাবলিগ জামাতে কিছু সংস্কারের কথা বলে আসছেন, যা এই তাবলিগে বিভক্তি সৃষ্টি করেছে।
সাদ কান্ধলভি বলেছেন, ‘ধর্মীয় শিক্ষা বা ধর্মীয় প্রচারণা অর্থের বিনিময়ে করা উচিত নয়’; যার মধ্যে মিলাদ বা ওয়াজ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ড পড়ে বলে মনে করা হয়।
সাদ কান্ধলভি আরও বলেছেন, ‘মাদরাসাগুলোর শিক্ষকদের মাদরাসার ভেতরে নামাজ না পড়ে মসজিদে এসে নামাজ পড়া উচিত, যাতে মানুষের সাথে যোগাযোগ বাড়ে।’
এদিকে কান্ধলভির বিরোধীদের দাবি, সাদ কান্ধলভি যা বলছেন, তা তাবলিগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা নেতাদের নির্দেশিত পন্থার বিরোধী। বিরোধীদের বক্তব্য, সাদ কান্ধলভির কথাবার্তা আহলে সুন্নাত ওয়া’ল জামাতের বিশ্বাস ও আকিদার বাইরে।
অন্যদিকে সাদ কান্ধলভির সমর্থকরা বলছেন, তাদের নেতার বক্তব্য বা সংস্কারের প্রস্তাব মানতে না পেরেই বাংলাদেশে সংগঠনটির কর্মকাণ্ডকে ‘রাজনৈতিক চেহারা’ দেওয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সাদ কান্ধলভির বিরোধী এক নেতার মতে, ‘সাদ কান্ধলভি এখনো এ মতবাদ ছাড়েননি। তাই এটা যেন বাংলাদেশে ছড়াতে না পারে এবং মুসলিমরা যেন পথভ্রষ্ট না হয়, সে জন্য তারা কাজ করে চলেছেন।’ এর মধ্যে এক কণাও রাজনীতি নেই বলে দাবি করেন তিনি।
ভারতীয় উপমহাদেশে সুন্নি মুসলমানদের বৃহত্তম সংগঠন তাবলিগ জামাতের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব প্রথম প্রকাশ্য রূপ পায় ২০১৭ সালের নভেম্বরে, যখন তাদের মূল কেন্দ্র কাকরাইলে দুই দল কর্মীর মধ্যে হাতাহাতি হয়।
তারপর এ বছর জুলাই মাসে ঢাকায় কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর উপস্থিতিতে তাবলিগ জামাতের একাংশের এক সম্মেলন হয় । এতে সাদ কান্ধলভিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করাসহ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ঢাকার মোহাম্মদপুরে অনুষ্ঠিত ওই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, দিল্লির তাবলিগের কেন্দ্রীয় নেতা সাদ কান্ধলভির বক্তব্য ও মতবাদকে অনুসরণ করা হবে না এবং আগামী বিশ্ব ইজতেমার সময় তাকে বাংলাদেশে আসতেও দেওয়া হবে না।
তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা মোহাম্মদ সাদ কান্ধলভির এসব চিন্তা-ভাবনা নিয়ে তাবলিগ জামাতের দুটি গোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের প্রভাব গত ইজতেমাতেও পড়েছিল।
সে সময় এ নিয়ে এক নজিরবিহীন ঘটনা ঘটে, যখন সাদ কান্ধলভি বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে ঢাকায় এসেও ইজতেমা প্রাঙ্গণে যেতে পারেননি।
সাদ কান্ধলভি তার বিরোধী পক্ষের প্রতিবাদের মুখে ঢাকায় তাবলিগ জামাতের কেন্দ্রীয় কাকরাইল মসজিদে অবস্থান নেন এবং পরে সেখান থেকেই দিল্লি ফেরত যান।
দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠী এখনো তবলিগ জামাতের প্রধান দফতর কাকরাইল মসজিদেই অবস্থান করছে, কিন্তু কার্যক্রম চালাচ্ছে আলাদাভাবে।
সাদ কান্ধলভির সমর্থক গোষ্ঠীর একজনের মতে, তাবলিগ জামাতের ৯০ শতাংশই ‘নিজামুদ্দিন মারকাজ’ বা সাদ কান্দলভির অনুসারী হিসেবেই আছেন। কিন্তু তার কিছু কথাকে একটি গোষ্ঠী সহজভাবে নিতে পারছেন না। তার বিরোধীদের পেছনে কওমি মাদরাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের লোকেরা সক্রিয় বলে বলা হলেও, হেফাজতের নেতারা এ অভিযোগ সরাসরি স্বীকার করেন না।
হেফাজতে ইসলামের একজন ঊর্ধ্বতন নেতা মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘এখানে হেফাজত বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
এ বিরোধ এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বের তাবলিগ জামাতের অনুসারীদের মধ্যে। ব্রিটেন, আমেরিকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তাবলিগ জামাতের নেতৃত্বের বিভক্তি দেখা দিয়েছে অনেক দিন আগেই। বিরোধ মেটানোর চেষ্টা থাকলেও তাতে এখনো ইতিবাচক ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।