প্রচ্ছদ সারাদেশ খুলনা বিভাগ কালীগঞ্জে কুমার, চিত্রা ও বেগবতি নদী ভরাট করছে নদিপাড়ের প্রভাবশালীরা

কালীগঞ্জে কুমার, চিত্রা ও বেগবতি নদী ভরাট করছে নদিপাড়ের প্রভাবশালীরা

স্টাফ রিপোর্টার, ঝিনাইদহঃ ঝিনাইদহ জেলাসহ কালীগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে চলা কুমার, চিত্রা ও বেগবতি নদী ভরাট করে ধান ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত বানানোর উৎসবে মেতেছে নদিপাড়ের প্রভাবশালীরা। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময়ের খরস্্েরাত এসব নদী। প্রয়োজনীয় সংস্কার না করায় তলদেশ ও নদীর দু’পাড় ভরাট হয়ে গভীরতা কমে নদী খালে পরিণত হয়েছে। ফলে নদীর তীরে চলছে ধান ও সব্জী চাষাবাদ। এদিকে স্থানীয় নদিপাড়ের প্রভাবশালীরা নদী দখলের মহোৎসবে ব্যস্ত। অনেকেই নদীর ভেতরেই গড়ে তুলেছেন দোকান, ঘর-বাড়ি। আবার এ জেলার যে সমস্থ শহরের উপর দিয়ে এসব নদি প্রবাহিত হয়েছে সে সব নদিগুলোর দু’পাশেন জমির মালিকরা বাসা-বাড়িসহ তৈরী করছে বহুতল ভবনসহ ভিভিন্ন ধরনের মার্কেট। এমন চিত্র ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত ঐতিহ্যবাহী চিত্রা ও বেগবতি নদীর। নদী দখল মুক্ত করতে বা খনন করে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে নেওয়া হচ্ছে না কোন ধরনের পদক্ষেপ। সরেজমিনে দেখা যায়, ঝিনাইদহের সদরের গান্না থেকে শুরু করে কালীগঞ্জের মঙ্গলপৈতা বাজার ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় ৩০ কিলোমিটার নদী পথ। এ নদীর অধিকাংশ জায়গায় উপরের পাড় কেটে কোন কোন ক্ষেত্রে ট্রাকে করে বাইরে থেকে মাটি এনে ভরাট করে ফসলি জমি তৈরি করা হয়েছে। বর্তমানে ফসলি জমির সীমানা দুই পাড়ে এমন স্তরে গিয়েছে যে নদীর সীমানা এখন দুই তিন হাত চওড়া ড্রেনের মত। বর্তমানে নদীর গভীরতা সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে ছয় হাত। অথচ কয়েক বছর আগেও ভরা বর্ষা মৌসুমে পানির গভীরতা থাকতো ১৫ থেকে ২০ হাত। এক সময়ে এই নদীর পানি দিয়ে পার্শ্ববর্তী ইরি ক্ষেতে সেচ কাজ চালানো হতো। আষাঢ় মাস থেকে কার্ত্তিক মাস পর্যন্ত ৫ মাস নদীতে বড় বড় টাবুরে নৌকায় এ এলাকার বিখ্যাত খেঁজুরের গুড়, ধান, পাট, বাতাবি লেবু, নারিকেল বোঝাই করে দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানি হতো। এসব নদীর পাড় গড়ে ওঠা গ্রাম গুলোতে রয়েছে অসখ্য জেলে পরিবার। তারা একসময় শুধু মাত্র এই নদীতেই মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। শুকনো মৌসুমেও আট থেকে ১০ হাত গভীরতার পানি থাকতো। অথচ বর্তমানে বর্ষা মৌসুম শেষ হওয়ার কয়েক দিনের ভিতরেই নদীতে হাঁটু পানি হয়ে যায়। নদীর পাড়ের চাষীরা বিভিন্ন জায়গায় উঁচু উঁচু বাঁধ দিয়ে পানি আটকিয়ে দুই পাড়ে চাষাবাদ করে। অনেকে নদী গর্ভে পুকুর তৈরি করে মাছ চাষ করছে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের দখলকৃত নদী সীমানায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের যেন প্রবেশই নিষেধ। এমনকি কোন কোন জায়গায় নদীতে সর্ব সাধারণের গোসল করতে বাধা দেওয়া হয়। কালীগঞ্জের পাচ শ্রীরামপুর, হেলাই, ফয়লা, রায়গ্রাম, মস্তবাপুর, ষাটবাড়িয়া, মনোহরপুর ও মঙ্গলপৈতা এলাকায় অনেকেই নদীর তলদেশ থেকে মাটি কেটে স্থানীয় ইট ভাটার মালিকদের কাছে বিক্রি করছে। অপরদিকে চাপরাইল বাজার ও মঙ্গলপৈতা বাজার এলাকায় প্রায় লোকই নদীর সীমানার ভেরতেই গড়ে তুলেছে দোকান ও বসত ঘর। তাদের অনেকের দাবী তারা সরকারী বন্দোবস্তোর মাধ্যমে ভোগ দখল করছে। তবে এলাকার সাধারণ জনগন মনে করে অচিরেই নদীর সীমানা নির্ধারণ করা ও খনন করে নদীর নাব্যতাসহ অতীত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা এখন সময়ের দাবী। না হলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ অঞ্চলের বিভিন্ন ফসলি মরুভূমিতে পরিণত হবে। কালীগঞ্জ উপজেলার হেলাই গ্রামের সেতু, শিংগী বাজারের সেতু ও মঙ্গলপৈতা বাজারের সেতুর ওপর দাঁড়ালে আর নদীটির স্বচ্ছ পানি দেখা যায় না। এসব এলাকার নদীগুলো ভরাটের শিকার হয়েছে শীর্ণ হয়ে গেছে। চিত্রার এবং বেগবতি নদীরপাড় কেটে নদী ভরাটের চিত্র নতুন কোন দৃশ্য নয়। ১০০ মিটার চওড়া এসব নদীগুলো এখানে প্রায় খালে পরিণত হয়েছে। এসব নদীগুলোর প্রস্থ প্রায় ৪-৫ মিটার হবে।এসব এলাকার কয়েকজন গ্রামবাসীরা জানান, এ অঞ্চলের প্রভাবশালী কয়েকজন কৃষক বছরের পর বছর ধরে নদী ভরাট করে ধান চাষ করে আসছেন। কালীগঞ্জ উপজেলার মঙ্গলপৈতা বাজারের পাশে চিত্রা নদী ভরাট করা অবস্থায় কয়েকজনের সাথে কথা বললে তারা বলে আমরা জোন হিসাবে মালিকের কাজ করি। এ বিষয়ে যারা জোন দিয়ে ভরা করাচ্ছে তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এসব অঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান তাঁদের জমি-সংলগ্ন নদীর পাড়কেও নিজেদের ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন। এ কারণে নদীর গতিপথ বন্ধ করে চাষাবাদ করেন। ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেন। এ বছরও অনেকেই ধানের বীজতলা তৈরি করেছেন নদীতে। আবার অনেকে ধান চাষও শুরু করেছেন। কিন্তু জনপ্রতিনিধি বা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কাউকে কখনো বাধা দিতে দেখা যায়নি। ঝিনাইদহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের সহকারী প্রকৌশলী মিরাজ গাজী জানান, যারা ফসলের ক্ষেত বানাতে নদী কাটছে এসব নদীর পাড় তারা অবৈধভাবে কাটছে। ইতোমধ্যে ঝিনাইদহে ডেল্টা প্লান-২১ প্রকল্পের আওতায় ৭ টি খাল খনন করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। টেন্ডার প্লট করা হয়ে গিয়াছে ৫ টা কাজের নওয়া দেওয়া হয়েছে এবং খাল খনন করা শুরু হবে। আর ছোট নদীগুলোর এটা হচ্ছে প্রথম প্রকল্প। এরপর ডেল্টা প্লানের আরেকটা প্রকল্প আসবে এসব প্রকল্পের মধ্যে আছে ঝিনাইদহের চিত্রা, কুমার ও নবগঙ্গা এই তিনটা নদি ধরা হবে। আর যারা অবৈধ দখল করে আসছে তাদের একটা তালিকা করে ডিসি অফিসে পাঠানো হয়েছে। এরপর প্রশাসন অবশ্যই তাদেরকে উচ্ছেদ করবে। আর বাদবাকী যে নদিগুলো ভরাট হয়ে আছে এবং অবৈধভাবে যারা নদির পাড় কেটে ভরার করছে প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এবং খনন করার প্রক্রিয়া চলছে। বেশ কয়েকটি নদী খনন করার জন্য ইতোমধ্যে একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। ঝিনাইদহের নদিগুলো খনন করার ব্যাপারে আমরা অলরেডি ডিপিপি পাঠায়েছি অচিরেই নদিগুলো খনন করার কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে। আর ঝিনাইদহ জেলার ৬ উপজেলার খালগুলো খনন করার কাজ এই মাসেই শুরু হবে। ডিপিপি প্রকল্পে আওতায় জেলার নদিগুলো খনন কাজের সব নদিই অন্তভূক্ত রয়েছে। প্রকল্পের আওতায় অবৈধ সব রকমের দখলদারীদের উচ্ছেদ করা হবে। এ ব্যাপারে কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সূবর্না রানী সাহা বলেন, বিষয়টি আমি এখন জানলাম নিজে সরোজমিনে তদন্ত করে দেখে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।